পশ্চিমবঙ্গের পাহাড় আর হাসিতেছে না। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সর্বাধিনায়ক বিমল গুরুঙ্গ জানাইয়াছেন, তাঁহারা আবার পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য আদায়ের দাবিতে আন্দোলনের পথ গ্রহণ করিতেছেন। আগামী মাসে চার দিনের বন্ধ ছাড়াও ১৯ দিন নাগাড়ে সব সরকারি দফতর অবরুদ্ধ হইবে। হয়তো এই উদ্যোগ তাঁহারা পুনর্বিবেচনা করিবেন, হয়তো দর কষাকষির কৌশল হিসাবেই এই জঙ্গি ভাব। কিন্তু দর কষাকষির বাস্তবটি উড়াইয়া দেওয়ার কোনও উপায় নাই, পাহাড়ের রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তাও অনস্বীকার্য। হঠাৎ কেন সৌহার্দ্যের হাসি মিলাইয়া গেল এবং গুরুঙ্গ রাজ্য সরকারের প্রতি ক্রুদ্ধ হইলেন, কেনই বা ‘বুকের মধ্যে লুকাইয়া রাখা’ গোর্খাল্যান্ডের দাবিটিকে বাহিরে টানিয়া আনিয়া তুমুল আন্দোলনের কর্মসূচি লইতে হইল, তাহা অনুমান করা কঠিন নয়। গুরুঙ্গের নিজের কথাতেই তাহার ইঙ্গিত রহিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁহার উত্তরবঙ্গ সফর কালে পার্বত্য দার্জিলিঙের আদি ভূমিপুত্র লেপচাদের জন্য স্বতন্ত্র পরিষদ গঠন করাতেই গুরুঙ্গ বিষম চটিয়াছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর এই পদক্ষেপ যে পাহাড়বাসীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করিয়া মোর্চার প্রভাব হ্রাস করারই প্রয়াস, তাহা আন্দাজ করিতে গুরুঙ্গের অসুবিধা হয় নাই। লেপচা পরিষদ গঠনের কথা জিটিএ চুক্তিতেই ছিল, কিন্তু জিটিএ-র অধীনেই তাহা গঠিত হওয়ার কথা এবং জিটিএ-র নিয়ামক হিসাবে গুরুঙ্গদেরই তাহা গঠন করার কথা। মুখ্যমন্ত্রী একতরফা ভাবে তাহা গড়িতে গিয়া লেপচাদের উন্নয়নে কোনও সদর্থক পদক্ষেপ করিতে না পারিলেও গোর্খাদের রুষ্ট করিয়া তুলিতে সমর্থ হইয়াছেন। বিমল গুরুঙ্গ গোর্খাল্যান্ডের দাবি সমর্থন করার জন্য যে ভাষায় লেপচাদের হুমকি দিয়াছেন, তাহাতেই ইহা স্পষ্ট। গুরুঙ্গ যে হুমকি প্রদর্শন ও চাপ সৃষ্টির রাজনীতির অনুশীলন শুরু করিয়াছেন, সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কথিত ‘পাহাড়ের হাসি’কে এক লহমায় ম্লান করিয়া দিয়াছে।
বিমল গুরুঙ্গের পরিবর্তিত অবস্থানের অন্য প্রেরণাটি যে তেলেঙ্গানার রাজ্যে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা হইতে আসিয়াছে, তাহা নিশ্চিত। এ জন্যই তিনি জিটিএ-র আধিকারিক এবং মোর্চার নেতৃত্ব ও নির্বাচিত বিধায়কদের দেশের বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানীতে পাঠাইয়া গোর্খাল্যান্ড গঠনের যৌক্তিকতা দেশময় প্রচার করার কর্মসূচি ঘোষণা করিয়াছেন। তেলেঙ্গানা রাজ্য হইলে পার্বত্য দার্জিলিং কেন হইবে না, গোর্খা নেতৃত্ব সেই জিজ্ঞাসাটিই তুলিয়া ধরিতেছে। শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা এখনও গুরুঙ্গের ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় কোনও উগ্র, জঙ্গি অবস্থান লন নাই। কিন্তু কত দিন তাঁহারা নিরস্ত থাকিবেন, বলা কঠিন। অথচ এখন প্ররোচনায় পা দিবার সময় নয়, বরং অতিশয় সন্তর্পণে পা-ফেলার সময়। জনজাতীয় সংবেদনশীলতায় আঘাত করার পরিণাম সরকারকে বুঝিতে হইবে, তাহাদের আবেগ ও স্পর্শকাতরতাকে খুঁচাইবার প্রবণতা হইতেও নিবৃত্ত থাকিতে হইবে। শুরুতে এই সতর্কতা অবলম্বন করিলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরে স্বভাবসিদ্ধ অহং চরিতার্থ করিতে অগ্রসর হন। ফল হাতেনাতে। |