|
|
|
|
গারো পাহাড়ের রাজার রথের চাকায়
ধুলো উড়ছে প্রচুর, কিন্তু জমিতে টান
রাজীবাক্ষ রক্ষিত • শিলং |
ভিড় করে থাকা প্রত্যন্ত গ্রামের উপজাতিরা অধীর অপেক্ষায়। অবশেষে ধুলো উড়িয়ে দেখা দিল রথ! অনেকেরই ধারণা ছিল হয়ত ঘোড়ায় টানবে রথের চাকা। কেউ বা আরও বড়সড় কিছু আশা করেছিলেন। কিন্তু আদতে রথের বাইরের চেহারা বাসের মতো দেখে যখন প্রজারা মনমরা, তখনই হৈ-চৈ! যাদুমন্ত্রে খুলে যাচ্ছে রথের ছাদ। প্রথমে উঁকি দিল রেলিং-এর মাথা। তারপর স্পিকার। তারও পরে হাত নাড়তে নাড়তে উঠে এলেন তিনি। পূর্ণ অ্যাজিটক সাংমা।হাততালি। হাততালি। জিন্দাবাদ ধ্বনি। তার কতটা তিনি পেলেন, কতটা তাঁর রথ তা সময়ই বলবে। রাজ্য যখন টলোমলো, তখনই প্রজাদের চমক লাগাতে রথ তলব করেছেন রাজা। কিন্তু টলোমলো মেদিনীতে সেই রথও কী তাঁর ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পারবে?
আক্ষরিক অর্থেই পি এ সাংমা ছিলেন পূর্ণ ‘অপরাজিত’ সাংমা। ১৯৮৮ সালে কংগ্রেসের হয়ে ৭৭৯ দিনের জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। তারপর ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে, দলে শরদ পওয়ারের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও শরদ-সনিয়া ‘মাখামাখি’র অভিযোগ তুলে দল ভাঙেন পূর্ণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। তৈরি হয় ‘অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস’। সে বার, মমতার দল মাত্র দু’টি আসন পায়। একটি দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রে স্বয়ং মমতা। অন্যটি, তুরায়, পূর্ণ সাংমা। তাও আবার মেঘালয়ের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমাকে হারিয়ে জিতেছিলেন পূর্ণ। |
তাঁর ‘হাই টেক’ রথের মাথায় পূর্ণ সাংমা।—নিজস্ব চিত্র |
তিনি পেয়েছিলেন ১,৯১,৯৩৮টি ভোট। মুকুল পান ১,১৯,১৭৫ ভোট। তবে মমতার সঙ্গেও পূর্ণর সম্পর্ক বেশিদিন টেকেনি। ২০০৬ সালে তিনি তৃণমূলের সঙ্গ ছাড়েন। সাংসদ পদে ইস্তফা দিয়ে ফের এনসিপির ছাতার তলায় এসে, এনসিপির টিকিটেই লড়েন তুরা থেকে। আবার মুকুলকে হারান। কার্যত, গারো পাহাড়ে পূর্ণ-পরিবারের প্রভাব কিংবদন্তীর পর্যায়ে। সাতবারের সাংসদ, দু’বারের বিধায়ক পূর্ণ। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে কোনও দিন নির্বাচনে হারেননি। কিন্তু এক দিকে, অতিদ্রুত মুকুল সাংমার উত্থান, অন্য দিকে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভরাডুবির পরে নিজের দূর্গ গারো পাহাড়েও তাঁর আসন টলোমলো। এনপিপি দলের হয়ে তাঁর লড়াইটা প্রধানত গারো পাহাড়ে। আনুগত্য হারাবার আশঙ্কা থেকেই হয়তো এ বার নিজের জন্য রথ বানিয়ে ফেললেন।
রথ বলতে একটি ‘স্টারবাস’। আডবাণীর রথ, লালু প্রসাদ-নীতিশ কুমারদের রথের আদলেই সেই বাসের ভোল বদলানো হয়েছে। দলের তহবিল থেকেই বাসটি কেনা। প্রায় তিরিশ লক্ষ টাকা খরচ করে বাসের ভিতরে শীততাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, সোফা-সহ বৈঠকখানা, রান্নাঘর, মাইক্রোওয়েভ আভেন, মাল্টিপারপাস ফ্রিজ, শৌচালয় বসানো হয়েছে। মধ্যভাগে রয়েছে লিফ্ট-সহ যান্ত্রিক ভাবে ওঠা-নামা করতে সক্ষম পোডিয়াম। এই বাসেই পূর্ণ তুরা, উইলিয়াম নগর-সহ উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম গারো পাহাড়ে নির্বাচনী সফর চালাচ্ছেন। এমন নির্বাচনী রথ অন্তত উত্তর-পূর্বে প্রথম। কিন্তু টক্কর বড় কঠিন। ভোট বাহনের নিরিখেও এগিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমা, তাঁর বাহন হেলিকপ্টার।
এ বারের নির্বাচনে ৩২টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে এনপিপি। এনসিপির ১২ জন বিধায়ক এবার তাঁদের সঙ্গে। কিন্তু সব আসনে প্রার্থী না দিয়েও কী ভাবে সরকার গড়ার স্বপ্ন দেখছেন? পূর্ণর কথায়, “গত বার কংগ্রেস ২৫টি আসন পেয়েও সরকার গড়তে পারেনি। আমরা ১৪ জন বিধায়ক নিয়েও অন্য স্থানীয় দলগুলির সাহায্যে সরকার গড়েছিলাম। এ বারেও আঞ্চলিক দল ও নির্দল প্রার্থীরা বড় ভূমিকা নেবেন।” পূর্ণ বাদে দলের বড় ভরসা তাঁর ছেলে, কনরাড। ফিলাডেলফিয়ার হোয়ারটন বিজনেস স্কুলের এমবিএ, ৩৫ বছরের ‘টেক-স্যাভি’ কনরাড ইতিমধ্যেই এমপিএ সরকারে বিদ্যুৎমন্ত্রী হিসেবে এবং কংগ্রেস আমলে বিরোধী দলনেতা হিসাবে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ে দলের মুখ পূর্ণ নন, কনরাডই। দল কোনও ভাবে ভাল ফল করলে এবং নির্বাচনের পরে আঞ্চলিক দলগুলির সমর্থন পেলে কনরাডই হবেন মুখ্যমন্ত্রী। আপাতত প্রচার রথে রাজ্য চষে ফেলছেন কনরাড ও পূর্ণ। এতদিনের ‘ঘড়ি’ চিহ্ন এ বার নেই, এ বার ‘বই’। প্রতীক চিনতে স্থানীয় মানুষের সমস্যা হবে না? পূর্ণ উবাচ, “এখানকার সব মানুষ আমায় ও আমার পরিবারকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। ভালবাসেন। তাঁদের কাছে প্রতীক নয়, পূর্ণ সাংমাই শেষ কথা।” সেই আত্মবিশ্বাসে ভর করেই ২৩ বছর পরে ফের রাজ সিংহাসন দখল করার স্বপ্ন দেখছেন গারো পাহাড়ের রাজা। |
|
|
|
|
|