|
|
|
|
অনিশ্চয়তা ছায়া ফেলেছে জনজীবনে |
‘আত্মঘাতী’ আন্দোলনে নামবে না কেউ, আশা পাহাড়ের নানা মহলে |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
‘গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (জিটিএ) নিয়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা এবং আদিবাসী বিকাশ পরিষদের সাম্প্রতিক ‘রণহুঙ্কার’ অনিশ্চয়তার ছায়া ফেলেছে দার্জিলিং পাহাড় এবং লাগোয়া সমতলে। কিন্তু নানা ধরনের হুমকি দিলেও, জনজীবন স্তব্ধ করে আন্দোলনের রাস্তায় কোনও দলই হাঁটবে না--এমন আশায় বুক বাঁধছে স্থানীয় চা ও পর্যটন শিল্প এবং শিক্ষা মহল।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতাপাহাড়ে যখনই আন্দোলন হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে চা এবং পর্যটনের মতো অর্থকরী শিল্পের। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাহাড়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি। তাই এ বার সাধারণ পাহাড়বাসী, সমতলের নানা পেশার মানুষজনের পক্ষ থেকে নানা রাজনৈতিক দল, সংগঠনের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের কাছে বার্তা দেওয়া হয়েছে, আন্দোলনের নামে কেউ ‘আত্মঘাতী’ পদক্ষেপ করলে তা ‘বরদাস্ত’ করা হবে না।
আমজনতার এই উদ্বেগকে গুরুত্ব দিচ্ছে রাজ্য সরকারও। ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে পাহাড়, তরাই-ডুয়ার্সের ‘সুস্থিতি’তে যাতে বিঘ্ন না ঘটে, সে জন্য জেলা প্রশাসনের কর্তাদের উদ্যোগী হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের কর্তারাও মোর্চা, আদিবাসী বিকাশ পরিষদ-সহ নানা সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। |
|
সোমবার উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, “দার্জিলিং পাহাড়, তরাই ও ডুয়ার্সের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বদ্ধপরিকর। সে জন্য অনেক কাজই শুরু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী ঘনঘন পাহাড়ে গিয়ে উন্নয়নের কাজও খতিয়ে দেখছেন। তাঁর নির্দেশ মন্ত্রীরাও নিয়মিত পাহাড়ে যাচ্ছেন। এমতাবস্থায় আন্দোলনের নামে অশান্তি করলে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটবে। যাঁরা নানা আন্দোলনের কথা বলায় অশান্তির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তাঁরা সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবেন বলে আমরা আশা রাখছি।” মন্ত্রীর সংযোজন, “মনে রাখতে হবে, মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগেই কেন্দ্র-রাজ্য ও মোর্চা, তিন পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে জিটিএ-চুক্তি হয়েছে। সব পক্ষকে তা মেনে চলতে হবে।”
মোর্চার প্রচার সচিব হরকাবাহাদুর ছেত্রী অবশ্য জানান, রাজ্য সরকার তাঁদের দাবি-দাওয়া মেনে নিলে পাহাড়ে নতুন করে ‘অশান্তি’র সূত্রপাত হত না। তাঁর বক্তব্য, “আমরা অশান্তি করতে যাব কেন? পাহাড়বাসীর প্রত্যাশা পূরণে কোনও ঘাটতি যাতে না হয়, তা রাজ্য সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। তা হলে কোনও সমস্যা হবে না।” মোর্চা সূত্রের খবর, নানা মহলের আর্জি ও রাজ্য সরকারের মনোভাব বুঝেই সোমবার আন্দোলন নিয়ে নতুন করে হুঁশিয়ারি দেননি বিমল গুরুঙ্গরা। পক্ষান্তরে, আদিবাসী বিকাশ পরিষদের রাজ্য সভাপতি বীরসা তিরকি বলেন, “আমরা নিজে থেকে আন্দোলনে যাব বলিনি। তরাই-ডুয়ার্সে মোর্চা পদযাত্রা কিংবা জনসভার নামে অশান্তি যাতে না করে, তা রাজ্য সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।”
বস্তুত, রবিবার গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রধান বিমল গুরুঙ্গ ৭ এপ্রিল থেকে লাগাতার পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সে আন্দোলনের হুমকি দিতেই নানা মহলে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। তার পরেই চা বাগান মালিকদের একাধিক সংগঠন, পর্যটন ব্যবসায়ীদের একাংশ ও পাহাড়ের বেশ কয়েকটি নামী বোর্ডিং স্কুলের পক্ষ থেকে ‘সুস্থিতি’ বজায় রাখার জন্য সব পক্ষের কাছে আর্জি জানানো হয়।
ওই আর্জির নির্যাসনানা আন্দোলনের জেরে প্রায় চার বছর পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বর্তমান রাজ্য সরকারের উদ্যোগে জিটিএ-চুক্তির পরে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা শুধু নন, বলিউড, টলিউডের চলচ্চিত্র পরিচালকেরাও ফের পাহাড়ের দিকে মুখ ফিরিয়েছেন। চা-শিল্পও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এমনকী, ‘টাউন অব স্কুলস’ হিসেবে পরিচিত কার্শিয়াং-সহ পাহাড়ের তিন মহকুমার বোর্ডিং স্কুলেও দেশ-বিদেশের ছাত্রছাত্রীদের ভিড় বাড়ছে। এই অবস্থায় আন্দোলনের জেরে অশান্তি হলে পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা থাকছে।
ঘটনা হল, এই আশঙ্কা অমূলক নয়। কারণ, গত বছর মার্চের গোড়ায় ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’ (মরসুমের বৃষ্টিপাতের পরে প্রথম যে চা পাতা হয়) তোলার পরে প্রায় তিন সপ্তাহ কারখানা থেকে বাইরে পাঠানো যায়নি। তখন মোর্চা চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করেছিল। এ বার ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’ তোলার মুখে ফের আন্দোলন হলে ক্ষতির বহর বাড়ার আশঙ্কা করছেন চা বাগান মালিকেরা। উল্লেখ্য, ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’-এর পাতার মান ভাল হওয়ায় দেশ-বিদেশের বাজারে প্রচুর দাম মেলে। অতীতের অভিজ্ঞতা কথা মাথায় রেখেই আন্দোলনকারীরা সাবধানে পা ফেলবেন বলে আশা করছে চা-মহল। ‘ডুয়ার্স ব্রাঞ্চ অব ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন’-এর সচিব প্রবীর ভট্টাচার্য জানান, আন্দোলনের পরিস্থিতি হলেও বাগানের স্বাভাবিক কাজকর্মে কেউ বাধা দিতে চাইবেন না বলে তাঁরা অনুমান করছেন।
একই সুর ‘ইস্টার্ন হিমালয়ান ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি সম্রাট সান্যালের গলাতেও। তিনি বলেন, “সংবাদ মাধ্যমে আন্দোলনের কথা জেনে দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা খোঁজ নিচ্ছেন। আমরা আশা করছি, পাহাড়বাসীর অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা মাথায় রেখে গ্রীষ্মের পর্যটন যাতে নির্বিঘ্নে কাটে, সে দিকে খেয়াল রাখবে সব রাজনৈতিক দলই।” |
|
|
|
|
|