|
|
|
|
পঞ্চায়েতিরাজ সম্মেলন |
|
নন্দীগ্রামের স্মৃতি উস্কেই
ভোটের প্রস্তুতি তৃণমূলের
সুব্রত গুহ • হেঁড়িয়া |
|
আগামী পঞ্চায়েত ভোটেও পূর্ব মেদিনীপুরে সেই নন্দীগ্রামের স্মৃতি উস্কেই বৈতরণী পেরোতে চাইছে তৃণমূল। ২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনেও নন্দীগ্রাম-কাণ্ডই পরিবর্তনের হাওয়া বইয়েছিল তৃণমূলের অনুকূলে। তার আগের বছরই ঘটে গিয়েছিল ১৪ মার্চ আর ১০ নভেম্বরের ‘গণহত্যা’। সিপিএম তথা তদানীন্তন শাসকদের বিরুদ্ধে জনতার ক্ষোভ তখন টাটকা। পাঁচ বছরে হলদি নদী দিয়ে অনেক জলই বয়ে গিয়েছে। নন্দীগ্রাম-সহ পূর্ব মেদিনীপুরের ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থেকে শুরু করে এখন মহাকরণেও তৃণমূলের নিয়ন্ত্রণ। তথাপি সেই নন্দীগ্রামের স্মৃতি উস্কেই সিপিএম তথা বামেদের বিরুদ্ধে জনতার রায় ফের নিজেদের অনুকূলে আনতে চাইছে এখনকার শাসকদল। আর সে ক্ষেত্রে নন্দীগ্রাম-নিখোঁজ-কাণ্ডে লক্ষ্মণ শেঠদের ধরা পড়ার ঘটনাকেই তুরুপের তাস করতে চাইছে তারা। এই গ্রেফতারের অনুষঙ্গেই নন্দীগ্রামের স্মৃতি ফেরাতে মরিয়া তৃণমূল।
রবিবার খেজুরির হেঁড়িয়ায় পঞ্চায়েতিরাজ সম্মেলনে দলের কর্মীদের ঠারেঠোরে সেই বার্তাই দিয়েছেন তৃণমূল নেতারা। যেখানে নন্দীগ্রাম আন্দোলনকেই রাজ্যে ৩৪ বছরের বাম-শাসনের অবসানের ‘ভিত্তিকেন্দ্র’ দাবি করেছেন যুব-তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি তথা তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। দলীয় কর্মীদের আরও উদ্বুদ্ধ হয়ে, নিজেদের মধ্যে যাবতীয় দ্বন্দ্ব-বিভেদ ভুলে কাজ করার আহ্বানও জানিয়েছেন দলের জেলা সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি মামুদ হোসেন। জেলায় ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের ভোটে আগের পাঁচ বছরে ক্ষমতাসীন থাকার কারণে এ বার যে তাঁদের কিছুটা কেফিয়ৎ দেওয়ার অবস্থানেও থাকতে হবেসেটাও অবশ্য কর্মীদের সামনে স্বীকার করেছেন মামুদ হোসেন। কিন্তু পঞ্চায়েতে তাঁদের ‘কাজ’ নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ যে থাকছেই, তা বুঝেই তৃণমূল নেতৃত্ব ফের নন্দীগ্রামের স্মৃতি তুলে ধরতেও চাইছেন।
পঞ্চায়েতের কাজে ‘প্রশ্নে’র অবকাশটা জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতির ভাষণেই স্পষ্ট। তিনি স্বীকার করেছেন, বিভিন্ন প্রকল্পে প্রচুর পরিমাণ অর্থ খরচ করতে না-পারায় পড়ে রয়েছে। এ ব্যাপারে পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের ‘সতর্ক’ হতেও বলেছেন তিনি। পাশাপাশই অবশ্য প্রশাসনের একশ্রেণির আধিকারিকের ‘অসহযোগিতা’র কথা বলে অর্থ খরচ করতে না পারার ‘যুক্তি’ও সাজিয়েছেন। যদিও এই ‘ব্যাখ্যা’কে চড়া সুরেই কটাক্ষ করছে আজকের বিরোধী, বামেরা। জেলা পরিষদের প্রাক্তন সিপিএম সভাধিপতি নিরঞ্জন সিহির যেমন বক্তব্য, “তৃণমূল বিরোধী দল হিসাবে অতীতে প্রশাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ করত। এখন তো প্রশাসনেও তারাই। নিজেদের পছন্দের আমলাও ঠিক করছে। আসলে জেলা পরিষদে ক্ষমতায় থেকেও ওরা চূড়ান্ত ব্যর্থ। সেই ব্যর্থতা ঢাকতেই এখন প্রশাসনের নামে দোষ চাপাচ্ছে।” বিরোধীদের দিক থেকে এমন তোপ আসতে পারে জেনেই সম্ভবত নন্দীগ্রাম-স্মৃতিকে হাতিয়ার করার চেষ্টা শুরু করেছে তৃণমূল।
বস্তুত, জেলা পরিষদের কাজ নিয়ে মামুদ হোসেনের বিবৃতিতেই ‘সঙ্কট’ স্পষ্ট। সহ-সভাধিপতি জানিয়েছেন, জেলায় এখনও অনুন্নত এলাকা উন্নয়ন তহবিলের ১০ কোটি টাকা পড়ে রয়েছে। এর মধ্যে জেলার পঞ্চায়েত সমিতিগুলিতে ২ কোটি ৬৪ লক্ষ ৮৭ হাজার টাকা এবং পঞ্চায়েতগুলিতে ৭ কোটি ৫২ লক্ষ ৩৮হাজার ৫০০ টাকা পড়ে। ইন্দিরা-আবাস যোজনায় পড়ে ৪ কোটি ৮৭ লক্ষ ৮৫ হাজার টাকা। ‘আশ্রয়’-প্রকল্পে (যা নাম-বদলে এখন ‘আমার ঠিকানা’) পড়ে রয়েছে ৫৩ কোটি টাকারও বেশি! ত্রয়োদশ অর্থ-কমিশনের ১৫ কোটি ১১ লক্ষ টাকার পুরোটাই পড়ে থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মামুদ হোসেন পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের স্মরণ করিয়ে দেন, এই টাকা ৩১ মার্চের মধ্যে খরচ না করতে পারলে পুরোটাই ফেরৎ চলে যাবে। মুক্ত তহবিলেরও একই হাল। পঞ্চায়েত সমিতিগুলিতে ৫০ লক্ষ ৯০ হাজার ১০০ টাকা এবং পঞ্চায়েতগুলিতে ১ কোটি ২৩ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে। একশো দিনের কাজে অবশ্য শ্রমদিবসের হার ১৬ দিন থেকে বেড়ে ৩০ দিন হয়েছে। কিন্তু কাজ আরও এগোতে গেলে অবিলম্বে ৫০ কোটি টাকা দরকার। না পাওয়া গেলে শ্রমদিবস আরও বাড়ানো যাবে না।
বিভিন্ন প্রকল্পে টাকা পড়ে থাকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেও সহসভাধিপতি কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক বৈষম্য, রাজ্য সরকারের উপর বিশাল ঋণের বোঝা এবং প্রশাসনের একশ্রেণির ‘অসহযোগিতা’র ওজর তুলেছেন। পাশাপাশি নিজেদের ভুলত্রুটি সংশোধনের ডাক দিয়ে নিজেদের ‘দায়’ও প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছেন। ঐক্যবদ্ধ ভাবে নির্বাচনে লড়ার আহ্বান জানানোর সঙ্গেই নন্দীগ্রাম আন্দোলনকে ফের তুলে ধরার কথাও বলেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। |
|
|
|
|
|