প্রবন্ধ ২...
বাঁধের জালে নদীরা বিপন্ন, প্রশাসন নীরব
ব্রহ্মপুত্র, তিব্বতে যার নাম সাংপো ও অরুণাচলে সিয়াং, নদীর জল অরুণাচলের পাসিঘাট শহরে শুকিয়ে গেল। চোখের সামনে, দেখতে দেখতে, ভর্তি নদীখাতের জল কমতে শুরু করল। তার পর প্রায় খালি হয়ে গেল নদীর বুক। ঘটনাটির, যাকে বলে ‘বটম লাইন’, হয়ে দাঁড়াল ‘চিন ভারতকে বিপন্ন করবার জন্য এই কাজ করছে’ বলে সন্দেহ। নদী শুকিয়ে গেলে দেশ কিংবা দেশের মানুষজন সত্যিই ‘বিপন্ন’ হয় তা হলে? দেশের শিক্ষিত লোকজন, পরিচালকবর্গ সত্যিই মনে করেন সে কথা? অরুণাচল-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্রহ্মপুত্রের জল জোগান দেয় যে সমস্ত বড় নদী, লোহিত টিরাপ সুবনসিরি তাওয়াং এদের ওপর অন্তত চারশোটি বড় বাঁধ তৈরি হবে বলে সরকারি ঘোষণা হয়ে আছে অনেক দিন। বড় বাঁধে আর যা-কিছু হোক না কেন, নদীটি মরে যায়, এ কথা আজ আর কোনও তর্কের বিষয় নয়। ঘরের দরজায় দামোদরই তো তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। দামোদরের কোনও জল গত অন্তত পাঁচ-সাত বছর ধরে হুগলিতে বা সাগরমোহনায় পৌঁছয় না, নদীর মুখের কাছে যে জল দেখা যায়, তা জোয়ার-ভাটায় আসা-যাওয়া সমুদ্রের নোনাজল। দামোদর এখন বিষাক্ত শিল্প-আবর্জনা ও কয়লাগুঁড়ো ফেলবার নালা, যেখানে স্বাভাবিক বর্ষার জল এসে লাগামছাড়া বন্যা ঘটায়। কোন গেট দিয়ে কী ভাবে সে জল বেরোবে, কবে, কতটা, কোথাকার লোকেদের বানডুবি ও রিলিফপ্রাপ্ত করবে মৃত নদীজলের এই সব বিলিব্যবস্থার জন্য সরকারকে বিরাট বাজেট ও বিভাগ পুষতে হয়। নদীটা যে নেই, তা জানেন সেই কয়েক লক্ষ মানুষ, যাঁরা ওর তীরে, ওর ওপর নির্ভর করে বাঁচতেন।
সুরধুনী গঙ্গার অববাহিকায় আজও বাস করেন ভারতের শতকরা পঁচিশ ভাগ লোক। প্রত্যক্ষ, কি অ-প্রত্যক্ষে দেশের শতকরা চল্লিশ ভাগ লোক এই নদী-সংসারটির সঙ্গে যুক্ত নিজেদের জীবিকার কারণে। ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা-সিন্ধু মিলে তিল-তিল প্রস্তরচূর্ণ থেকে তৈরি মাটি দিয়ে হিমালয় থেকে গণ্ডোয়ানাল্যান্ড পর্যন্ত গাঙ্গেয় সমভূমির উর্বরতা গড়েছে অগণিত বছর ধরে। সেই গঙ্গার জল ও মাটির যে জটিল, সূক্ষ্ম, সুদূর প্রভাবময় প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা, গত মাত্র ষাট-সত্তর বছরে তা ভয়াবহ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রথমে সমতলে, এখন পাহাড়ের সুদূর উচ্চতায়ও। গঙ্গাকে অবিশ্বাস্য ভাবে বাঁধা হচ্ছে তার জন্মঘরে। গঙ্গোত্রীর ঠিক চোদ্দো কিমি নীচে ভৈরোঘাঁটি থেকে শুরু করে হৃষিকেশ পর্যন্ত, যেখানে গঙ্গা সবচেয়ে স্বচ্ছতোয়া, সবচেয়ে প্রবল তেজে পাথর কেটে প্রস্তরচূর্ণ আর জঙ্গলের প্রাণরস নিয়ে সমতলের দিকে নামছেন, সেই দেড়শো কিমি পথটুকুর মধ্যে তৈরি হতে যাচ্ছে এগারোটি বড় বাঁধ। টিহ্রির নির্মাণ প্রায় শেষ। অন্যগুলির কোনওটিতে কাজ এগোচ্ছে, কোনওটিতে শুরুর মুখে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাঁধ তৈরির মুখ্য উদ্দেশ্য বলা হচ্ছে ‘জলবিদ্যুৎ উৎপাদন’।
বদ্ধ-ধারা। গঙ্গার উপর টিহ্রি বাঁধ।
সত্যি কতটা বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, হলে তা কোন কোন শহরের ঝলক বাড়াবে, আমরা জানি না। কিন্তু যে হিমালয় এ দেশের ‘শেষ হাসপাতাল’, যে গঙ্গা ও হিমালয় এই উপমহাদেশটির অস্তিত্বের, কেবল ভৌগোলিক নয় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের, অন্যতম প্রধান নির্ণায়ক, সেই প্রাকৃতিক সংস্থান দু’টি এই সমস্ত কার্যসূচির ফলে অচিকিৎস্য ভাবে বিপন্ন হবে, এ কথা স্থির নিশ্চিত। একটি মাত্র বাঁধের নির্মাণকাজেও দৈনিক ৩০০০ ব্যাগ সিমেন্ট ব্যবহার হচ্ছে। সেই গোলা সিমেন্ট-মশলার একটা অংশ পাহাড়ের ঢাল গা বেয়ে নেমে নীচের জলধারাগুলিতে জমা হচ্ছে, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের নিয়মাবলি গ্রাহ্য না করেই।
লোহারিনাগ পালা, পালামানেরি, মনেরিভ্যালি ১ ও ২ এই বাঁধগুলোর মধ্যে দূরত্ব খুব কম, মাত্র আট-দশ কিলোমিটার হওয়ার দরুন একটি বাঁধ থেকে আর একটিতে গঙ্গাকে টানেলের মধ্য দিয়ে পার করানোটা পরিকল্পনাকারদের কাছে ‘সুবিধাজনক’ মনে হয়েছে এবং সেই মতোই কাজ চলছে। পার্বত্যপ্রবাহে সুরধুনী জাহ্নবীর যে দু’টি প্রধান উপনদী অলকানন্দা ও মন্দাকিনী, তাদের জল আর পৌঁছবে না গঙ্গা পর্যন্ত, কেননা আরও বারোটি বাঁধ তৈরি হতে চলেছে তাদেরও ওপর। কোনও একটি শব্দ যদি ভারতে জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের মধ্যে অস্মিতার বোধ জাগিয়ে তোলে, তবে তা ‘গঙ্গা’। নদীকে যখন টানেলের মধ্যে দিয়ে পার করা হবে, তখন আর মাটির ওপরে, পাহাড়ের গায়ে তার কোনও বহমান ধারা থাকবে? উত্তরাঞ্চলের কিছু কিছু জায়গায় গঙ্গার নিজের আলয়ে গঙ্গার খাত এখনই প্রায় খালি। গত দশ বছরের মধ্যে যাঁরা বর্ষা ছাড়া অন্য কালে প্রয়াগে গিয়েছেন, তাঁরা জানেন, প্রয়াগের সেই বিখ্যাত দুই রঙা জলের প্রবাহ নেই আর। যে ঘনবর্ণ জল বয়ে যাচ্ছে, তা কেবলই যমুনার। নিম্নপ্রবাহে যে গঙ্গাধারা এখনও দেখি, তা মাঝপথে নদীতে এনে ঢালে কোশি-শোণভদ্র-পুনপুন-মহানন্দা। ধুঁকতে ধুঁকতে যতটুকু সাধ্য জল আনে। পাসিঘাটে সিয়াং নদী শুকিয়ে গেলেও গুয়াহাটি জানতে পারে না। তার একটা কারণ যেমন গা-ঘেঁষে-থাকা শহরগুলির মানুষদের নদীর প্রতি অমনোযোগ, অন্য একটি কারণ তেজু থেকে ব্রহ্মপুত্রে তার জলসম্ভার নিয়ে এসে পড়ে লোহিত নদী। তার পর গুয়াহাটি শহরের আশপাশেই যতই ক্ষীণতোয়া হোক, আছে ভরলু-রঙ্গিয়া-বশিষ্টধারার মতো ছোট নদীরা।
ব্রহ্মপুত্র বিপন্ন অনেক দিন। ডিব্রুগড়ে বগীবিলের কাছে দু’পাশ থেকে এমব্যাঙ্কমেন্টের শিকল বাঁধা শুরু হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে, ৬ কিমি দীর্ঘ বগীবিল রেল-সেতু নির্মাণে। আর তার পেছনের অংশ রহমোরিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল আর এক মালদহ, পঞ্চানন্দপুর। ঝুপ ঝুপ করে প্রায় কুড়িটা গ্রাম এক বছরে ধসে পড়ে। অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে।
ভারতবর্ষ আক্ষরিকই নদীমাতৃক। নদীরাই অঞ্জলি ভরে উর্বর মাটি এনে এ দেশের ভূমি গঠন করেছে। সেই মাটি স্রোতধারায় কেটে তৈরি করেছে অববাহিকা। পাললিক মৃত্তিকার রকমফেরে এ দেশ হয়ে উঠেছে কৃষিপ্রধান (কিন্তু একমাত্র কৃষিভিত্তিক নয় আদৌ) এক সমৃদ্ধ সভ্যতার প্রাচীন আসন। ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর ও হিমালয় পর্বত মিলে বর্ষাজলের অমৃতভাণ্ডারকে এ দেশের মাটির ওপরে ও ভেতরে স্তরে স্তরে সাজিয়ে রেখেছে। আজ অল্প কিছু মানুষের ‘সব চাই, এক্ষুনি’ উন্মত্ত লোভ এই সমগ্র ভূমিকে বিনাশে উদ্যত। আমরা আছি ভারতজননী এই মহানদীদের শেষ প্রান্তে। নদী আনীত পলিমাটির আশীর্বাদে এ দেশের জন্ম-বৃদ্ধি। মৃত নদীদের অভিশাপও সবচেয়ে আগে, সবচেয়ে বেশি করে লাগবে এই প্রান্তেই। সে মার শুরু হয়েছে। রক্ষা পাবার চেষ্টা না করে আমরা এখনও অন্যমনস্ক।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.