|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
অন্য এক যুদ্ধ জিতে নিল অন্য এক ইরান |
বিদেশি ভাষায় শ্রেষ্ঠ ছবির শিরোপা পেল আসগর ফারহাদির ‘আ সেপারেশন’। ইরানে খুশির হাওয়া।
এবং, তার পরেই, ছমছমে নীরবতা। কেন?
চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় কূটনীতির আলো ফেলেছেন সেমন্তী ঘোষ |
গণতন্ত্র বিস্তারের সবচেয়ে ভাল মাধ্যম সিনেমা! বলেছিলেন ডাচ ঐতিহাসিক জোহান হুইজিঙ্গা, গত শতকের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অন্যতম পুরোধা। বলেছিলেন, সিনেমাই কেবল তৈরি করতে পারে সেই পথ যা ধরে উঁচুনিচু কাছের দূরের যে কোনও দেশের মানুষ যে কোনও অবস্থান থেকে জীবনের একই রকম ছবি দেখতে পায়, বুঝতে পারে। তাঁর বক্তব্যটা ছিল এই রকম: There is no stronger promoter of democracy in this sense than the cinema. It accustoms the nation, from high to low, to a single common view of life.
ঠোঁটে তর্ক এসে যাচ্ছে? না, তর্ক থাক। বরং যে প্রসঙ্গে হুইজিঙ্গার এই আর্ষবচনটি মনে পড়ল, সেটাই বলা যাক। ফেব্রুয়ারির শেষে আমেরিকায় অস্কার অনুষ্ঠানে এ বার যে আশ্চর্য কাণ্ড দেখা গেল, তাতে মনে হল, গণতন্ত্র না হয় না-ই হল, অন্তত কূটনীতির দুনিয়ায় সিনেমার অবদান নিয়ে এক্ষুনি ভাবনাচিন্তা দরকার, কূটনৈতিক দূত হিসেবে সিনেমাকে আরও কী ভাবে ব্যবহার করা যায়, বোঝা দরকার। সিনেমা দিয়ে যুদ্ধ ঠেকানো যায় কি না, সেটাও দেখা দরকার। কে জানে, হয়তো সে চিন্তা ইতিমধ্যে শুরুও হয়ে গিয়েছে। কে জানে, হয়তো এ বারের অস্কার উৎসবে শ্রেষ্ঠ বিদেশি ছবি হিসেবে যে সিনেমাটি পুরস্কৃত হল, তার পিছনে তেমন কোনও নিভৃত হিসেবই নিহিত। নয়তো কী করেই বা ঘটল এমন সমাপতন গোটা বিশ্ব যখন ইরান ও ইজরায়েলের পারস্পরিক হুমকির আদানপ্রদানে জেরবার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন এক মুখে গরম ও অন্য মুখে শান্ত বার্তা বিতরণ করে পরিস্থিতি আরও জটিল করছে, ঠিক তেমন সময়ে, অস্কার প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে উঠল যে ক’টি বিদেশি ছবি, তার মধ্যে একটি ইরানি, আর একটি ইজরায়েলি! জিতল শেষে ইরানি ছবিটিই, আসগর ফারহাদির ‘আ সেপারেশন’। |
|
প্রেক্ষাপটটা দেখা যাক। মার্কিন দেশে এখন ইরান-জুজুর ভয় ঘরে ঘরে। এক দশকে দু’দু’টি যুদ্ধ লড়া হয়েছে, তার মধ্যেই আবার নতুন ইন্ধন ইরানের পরমাণু বোমা? ইরান যে পরমাণু বোমা বানাচ্ছেই, এমন প্রমাণ যদিও এক বিন্দুও মেলেনি, কিন্তু পরমাণু শক্তি বানাতে তেহরানের যখন এতই জেদাজেদি, তখন বোমা কি আর ওরা না বানিয়ে ছাড়বে? এই সব যুক্তি, ভীতি, রাগ, ঘৃণার এন্তার আবাদ যখন চলছে দেশের পুব উপকূলের ওয়াশিংটন ডিসি’তে, ঠিক তখনই দেশের পশ্চিম উপকূলে লস এঞ্জেলসে লাল কার্পেট-মোড়া প্রেক্ষাগৃহে বেজে উঠল সুস্মিত আবহসংগীত, ঘোষিত হল, বিশ্বময় প্রতিযোগীকুলের মধ্যে জয়ের মুকুট ইরানের মাথায়! আশ্চর্য, প্রেক্ষাগৃহ সঙ্গে সঙ্গে ফেটে পড়ল হাততালিতে, পশ্চিম এশিয়ার কোনও দেশের ভাগ্যে প্রথম এই পুরস্কার জয়ের মুহূর্তটিতে পাশ্চাত্য নাগরিকসমাজের যে স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস, সিনেমা এবং কূটনীতি দুই জগতের কাছেই তা স্মরণীয় হয়ে রইল।
আশ্চর্য আরও। সে দিন যে ইজরায়েলিরাও হুমড়ি খেয়ে পড়বেন অনুষ্ঠান দেখতে, সেটা তো স্বাভাবিক। লাল কার্পেটের যুদ্ধক্ষেত্র বলে কি যুদ্ধের উত্তেজনা কিছু কম? স্নায়ুচাপের ঊর্ধ্বগতি কিংবা পরাজয়ের তীক্ষ্ণ গ্লানি: সবটাই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক যে, লস এঞ্জেলসে ইজরায়েলি কনসুলেটের আয়োজনে সমবেত সম্ভ্রান্ত ইহুদিরা টিভিতে যখন চূড়ান্ত ঘোষণাটি শুনলেন, হতাশার মর্মরধ্বনি ভাসিয়ে দিল ঘর। কিন্তু তার মধ্যেও আশ্চর্যের কমতি নেই: অনুষ্ঠানে উপস্থিত বহু ইহুদি দর্শক নাকি মন্তব্য করেছেন, সেরা ছবিই জয় পেয়েছে, ইজরায়েলের ছবি ‘দ্য ফুটনোট’ ‘ভালই’, কিন্তু ‘আ সেপারেশন’ হল ‘পারফেক্ট’, ত্রুটিহীন! কেউ যুক্তি দিতে পারেন, এ সবই তো বলার জন্য বলা, আর তা ছাড়া যাঁরা সে দিন ওই অনুষ্ঠানে সশরীরে থাকার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন, তাঁরা তো ঠিক আমজনতা নন! সবই ঠিক, কিন্তু এও কি আশ্চর্য নয় যে, এর মাসখানেক আগেই ইজরায়েলের নানা থিয়েটারে যখন এই ছবি দেখানো হচ্ছিল, প্রতিটি শো-ই ছিল হাউসফুল, প্রায় তিরিশ হাজার মানুষ উপচে পড়েছিলেন ছবি দেখতে।
|
অন্তর্ঘাত বাহিরে অন্দরে |
কূটনীতি চরিত্রগত ভাবেই কূট, সহজ পথে সে বিচরণ করে না। ইরানে এই ‘বিশ্বজয়ের’ সংবাদ পৌঁছতেই যে গোটা দেশের হৃদয় ময়ূরের মতো নেচে উঠবে, এমনটা হয়তো আশা করাই অন্যায়। অথচ ঘটনা হল, সে দেশে স্যাটেলাইট সংযোগে মার্কিন চ্যানেলগুলি নিষিদ্ধ বলে বেআইনি স্যাটেলাইটের খোঁজে সে দিন উতরোল হয়েছিলেন তেহরানবাসী, সংবাদ আসামাত্র দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন আনন্দে! জাতীয় চ্যানেলগুলিও ঘোষণা করেছিল, জায়নবাদীদের হারিয়ে ইরানের জয়! কিন্তু তার পরই হঠাৎ চকিত পালাবদল। পিছু হটার তাড়া। জাতীয় প্রচারমাধ্যমে দু’দিন না যেতেই ছমছমে নীরবতা, ‘আ সেপারেশন’-কে নিয়ে উচ্ছ্বাস তো দূরস্থান, কেমন যেন বিরুদ্ধতার ইশারা। কারণ বোঝা গেল ক্রমে। পশ্চিম পৃথিবী যাকে পুরস্কৃত করে, মাথায় তোলে, স্বতঃস্ফূর্ত হাততালিতে অভিনন্দিত করে, তার নিশ্চয়ই ভয়ংকর কোনও পশ্চিমী ব্যামো আছে! অর্থাৎ? অর্থাৎ, ফারহাদির চলচ্চিত্র অতীব কুৎসিত, ইরান সম্পর্কে বিকৃত ছবি তুলে ধরার জন্যই তার এই কদর। সরকারি বৃত্তে গালাগালির বন্যা বয়ে গেল। বিবাহবিচ্ছেদের এই ছবিতে সাংসারিক অশান্তি, লিঙ্গবৈষম্য, আধুনিকমনস্ক নাগরিকের দেশ ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার বাসনা, এ সবই কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার নয়? তেহরানের এক রক্ষণশীল সমাজতাত্ত্বিক এব্রাহিম ফৈয়াজ প্রচারমাধ্যমে জানালেন, এই কদর্য ‘ব্ল্যাক, রিয়্যালিস্টিক’ ছবিটিতে ইরানকে এক ক্ষয়িষ্ণু দেশ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যেন এক পলিতকেশ বৃদ্ধ, মনোবিকলনের রোগী। “পশ্চিমী দেশগুলি তো খুশি হবেই, তাদের খুশির জন্যই তো এই ছবির নির্মাণ!” |
|
‘আ সেপারেশন’ ছবির একটি দৃশ্য। |
কূটনীতি থেকে রাজনীতি, রাজনীতি থেকে গুন্ডামি। ফারহাদি তেহরানের সরকারি অভিনন্দন তো পেলেনই না। ইরানের শিল্পী-সাহিত্যিক-চলচ্চিত্রকারদের কিছু গোষ্ঠী যখন সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে ছোট একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁকে অভিনন্দিত করার সিদ্ধান্ত নিলেন, সরকার থেকে হল ‘বুক’ করার অনুমতি দেওয়া হল না। অনুষ্ঠান বাতিল হল। যে ফারহাদি এক দিন তাঁরই সতীর্থ জাফর পানাহির গ্রেফতারের প্রতিবাদে পথে নেমেছিলেন, আর সেই অপরাধে আজকের পুরস্কৃত সিনেমা ‘আ সেপারেশন’-র শুটিং গোড়াতেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, (ফারহাদি ক্ষমা চেয়ে আবার শুটিং চালু করতে পেরেছিলেন), আজ তিনি আবার নতুন করে রাষ্ট্রীয় ক্রোধের লক্ষ্য। প্রসঙ্গত, বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্র-নির্মাতা জাফর পানাহি এখনও তেহরানে গৃহবন্দি, সিনেমা-সম্পর্কিত কোনও কাজে যেন তিনি হাত না দিতে পারেন, পুলিশ প্রহরা প্রতি মুহূর্তে। তবে সৃষ্টিশীলতার তরঙ্গ থামায় কে! বাড়ি বসেই পানাহি মোবাইল ফোনের ছোট্ট ক্যামেরায় ছবি তুলে, নিজের পুরনো চিত্রনাট্যের নানা অংশ এক বন্ধুর মুখ দিয়ে বলিয়ে তৈরি করে ফেলেছেন নতুন ছবি ‘দিস ইজ নট আ ফিল্ম’। কেক-এর মধ্যে পেন ড্রাইভ পাচার করে সে ছবি ইতিমধ্যেই পৌঁছেছে ইউরোপে, সে নাকি এমন এক ছবি যার যোগ্য দর্শক এখনও পায়নি পৃথিবী!
পানাহি বিদ্রোহী। ফারহাদি বিদ্রোহী নন। ‘সিস্টেম’-এর ভিতর নানা কম্প্রোমাইজ করে এগোন তিনি, আবার ‘সিস্টেম’কে ‘সাবভার্ট’ও করেন, নিজের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অন্তর্ঘাত তৈরি করেন। এই যে শোনা যাচ্ছে ‘আ সেপারেশন’ এমন একটি ছবি যা ‘অন্য’ ইরানকে চেনায়, আমেরিকা ইউরোপ ইজরায়েল, এমনকী নিকট প্রতিবেশী দেশগুলিও ‘ইরান’ বলতে যা বোঝে, তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ব্যঞ্জনা তৈরি করে ধাক্কা দেয়, আধুনিক ইরানের আধুনিক নাগরিকের আনন্দ-বেদনা-সংকটের কথা বলে, এটা বিশ্ব-রাজনীতিতে অন্তর্ঘাত। আবার এই একই ছবি যখন ইরানি সাধারণ্যের মধ্যে লুকিয়ে আত্মপ্রত্যয় জাগায়, আর ইরানের শাসকসমাজকে বিরক্ত, ক্রুদ্ধ করে তোলে সেখানেও তার আর এক অন্তর্ঘাত। চুপিসাড়ে এমন অন্তর্ঘাত হানাও কিন্তু ইরানের অতি নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ফারহাদি তাই অস্কার মঞ্চে বক্তৃতায় বলেন “At this time, many Iranians all over the world are watching us and I imagine them to be very happy. At the time when talk of war, intimidation and aggression is exchanged between politicians, the name of our country is spoken here through her glorius culture, a rich and ancient culture that has been hidden under the heavy dust of politics...”
শিল্প হিসেবে এই ছবির মূল্য যা-ই হোক, আজকের যুদ্ধক্ষয়ী বিশ্বের ধুলোধূসর গহ্বর থেকে একটা দেশের চলিষ্ণু সমাজের ছবিকে সর্বসমক্ষে টেনে আনাটাও কিন্তু আর এক রকমের কূটনীতিই বটে। সেটারও মূল্য কম নয়। হুইজিঙ্গার কথাটা তাই নতুন করে ভাবাচ্ছে আজকাল! |
|
|
|
|
|