বিরিঞ্চিবাবা অমিতশক্তিধর। সকলই তাঁহার ইচ্ছা। চাহিলে তিনি যে কোনও ব্যক্তিকে সুদূর অতীতে লইয়া যাইতে পারেন। পরশুরামের কাহিনি তো বটেই, সেই গল্পাবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্ছবি ‘মহাপুরুষ’-এও (পাশের ছবিতে) বিরিঞ্চিবাবার বৃত্তান্ত সুবিদিত। বাবার অতিলৌকিক বিদ্যার কথা জানিয়াই না জনৈক সাহেবি কেতার ভদ্রলোক ডুকরাইয়া উঠিয়াছিলেন, ‘নাইন্টিন ফোরটিন’! হেঁয়ালি নহে, ভদ্রলোকের বাস্তবজ্ঞান প্রখর। বাসনা ছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কালে ফিরিয়া জলের দরে লোহা কিনিবেন। পরক্ষণেই কাল পারাবার পাড়ি দিয়া কয়েক দশক পরে আগমন, এবং অগ্নিমূল্যে সেই লৌহ বিক্রয়। মুনাফা রুখে কে? সম্প্রতি কলিকাতা হাইকোর্ট যখন সবিস্ময়ে জানিতে চাহিল, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে প্রাতরাশ হইতে নৈশাহার পর্যন্ত চার দফায় নানাবিধ সু-পথ্য দুগ্ধ-কদলী হইতে মাছ-মাংস পর্যন্ত কী রূপে দৈনিক সর্বমোট মাত্র ৩৭ টাকায় মিলিতে পারে, তখন একটি উত্তর হইতেই পারিত, বিরিঞ্চিবাবা! আদালত তাহাতে সন্তুষ্ট হইত কি না, বলা কঠিন, কিন্তু এমন কাজ আর কে-ই বা করিতে পারেন বিরিঞ্চিবাবা ছাড়া? তিনি যদি মন্ত্রবলে হাসপাতালগুলিকে বিশ শতকের প্রথম ভাগে লইয়া যাইতে পারেন, তাহা হইলে এমন কাণ্ড সম্ভবে, নচেৎ খুবই কঠিন। অসম্ভব বলিলেও আপত্তি উঠিবে না। একবিংশ শতক আসিয়াছে। খাদ্যের মূল্যমান শতাব্দীপ্রাচীন করিয়া রাখিলে সর্বদা টাটকা, উত্তম মানের বস্তু না-ও মিলিতে পারে।
বস্তুত, না-ই মিলিতে পারে। বাকচতুর অমিত রায় একদা বলিয়াছিলেন, ভাল জিনিস কম হইলেই ভাল। আমজনতা একমত হইবে না। ভাল জিনিস চতুর্দিকে থাকিলে তবে না স্ফূর্তি! সমস্যা হইল, ভাল জিনিসের মূল্যটি কী হইবে? ‘ভাল’ দাম সর্বদা পকেটের পক্ষে ‘ভাল’ নহে। সুতরাং, মনের মতন বস্তু চাই মনোরঞ্জক মূল্যে! কার্যকালে ইহা কাঁঠালের আমসত্ত্ব চাহিবার শামিল। অর্থনীতির একটি ধারণা ‘ভেবলেন এফেক্ট’ বলে, অনেক সময় দাম কম হইলে উপভোক্তা ধরিয়াই লন, জিনিসটি সুবিধার নহে। তাই অনুরূপ বস্তু যদি নিম্নতর মূল্যে মিলিয়াও যায়, তিনি অধিকতর মূল্যবান বস্তুটিই কিনিবেন। পশ্চিমবঙ্গের হাসপাতালে প্রদত্ত খাদ্যবস্তুর ক্ষেত্রে ঠিক এই কারণে বলা চলে না, কিন্তু অনুরূপ একটি সন্দেহ দেখা দিয়াছে। খাদ্য তো মিলিল, তাহার গুণমানটি সংশয়াতীত কি? বিশেষত, যে সকল আহার্য ও পানীয়ের কথা এই ক্ষেত্রে বিবেচ্য, তাহারা চরিত্রবিচারে পথ্য। রোগীর পথ্য। সুতরাং, তাহার গুণমান যথাযথ না-হইলে মুশকিল। সমস্যা হইল, যে মূল্যমান ধরা হইয়াছে, এবং পথ্যবস্তুর যাহা তালিকা, চার বেলা দূরস্থান, ওই অর্থে এক বেলারই ঠিক মতো সংস্থান করা কঠিন। হিসাব কষিতে বসিলে, হাতে পেনসিলের অধিক কিছু থাকাই কঠিন। ন্যায্য মূল্য বলিতে সর্বদা যথেষ্ট কম দাম বোঝায় না, যথেষ্ট বেশি দামও বুঝাইতে পারে।
প্রশ্ন হইল, সেই মূল্য ধার্য করিবে কে? জনতা ভাল জিনিস চাহে। এবং, কম দামে চাহে। যদি কেহ তাহা দিতে পারেন, জনচিত্তে তাঁহার আসন চিরস্থায়ী হইবার সম্ভাবনা ষোলো আনা। এমন বিচিত্র জনমুখিনতা এক্ষণে, বাজেটের কালে, কেন্দ্র ও রাজ্য নির্বিশেষে বিভিন্ন সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখিয়াছে। যুক্তি এক কথা বলে। ভোট আর এক। ইহাদের ভিতর দ্বন্দ্ব বাধিলে যুক্তিকেই বিদায় করা শ্রেয়। এই মূল্য-মানের ভাবনা বড়ই তাৎপর্যময়। বিত্ত না-ই বা হইল, অন্তত ভর্তুকি বাঁচিয়া থাক। কবে এক ভাবুক কবি গাহিয়াছিলেন, চাই না মা গো রাজা হতে! সেই ভাবনা ফিরিয়া আসিয়াছে। নব কলেবরে। অল্পেই সুখ! |