কোঝিকোড় পার্টি কংগ্রেসের ঠিক মুখে কেন্দ্রীয় কমিটিতে সমালোচনার মুখে পড়লেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। সাংগঠনিক ক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশ-সহ হিন্দিবলয় থেকে মুছে যাওয়া এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ছ’টি ভুলের জন্য কারাটের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছে। পলিটব্যুরো সূত্রের খবর, দলের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্টেও কারাটের এই ‘ব্যর্থতা’ নথিবদ্ধ হয়েছে। যা নিয়ে পার্টি কংগ্রেসে বিতর্ক হতে চলেছে।
উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের ফলাফল নিয়ে দলের মধ্যে আগেই প্রশ্ন উঠেছিল। দিল্লিতে তিন দিনের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে তারই ছায়া পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিনয় কোঙার-সহ কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা প্রশ্ন তুলেছেন, খোদ সাধারণ সম্পাদক যে রাজ্যের দায়িত্বে, সেই উত্তরপ্রদেশে পার্টি কেন দাঁত ফোটাতে পারে না! কেন সেখানকার স্থানীয় সমস্যা নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা হয়নি? বিতর্কে উত্তরপ্রদেশের রাজ্য সম্পাদক এস পি কাশ্যপ বোঝানোর চেষ্টা করেন, দুর্বল সংগঠনই তাঁদের মূল সমস্যা। এখানে প্রশ্ন উঠেছে, প্রায় দু’দশক ধরে সাধারণ সম্পাদক নিজে যে রাজ্যের দায়িত্বে, সেই রাজ্যেও কেন সংগঠন মজবুত করা যায় না?
রাজনৈতিক দিক থেকেও এ বারের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক কারাটের কাছে ছিল কার্যত ‘শরশয্যা’। বৈঠকে কারাটের ৬টি ভুল তালিকাভুক্ত হয়েছে। পার্টি কংগ্রেসে আলোচনার জন্য রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট চূড়ান্ত হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৮ সালে পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করে কেন্দ্র থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের পর থেকে ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত ছ’টি ভুল করেন কারাট। যার খেসারত দিতে হয়েছে দলকে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে ‘কারাটপন্থী’-রা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এই ছয় ভুল নিয়ে কিন্তু গোটা দল একমত।
কী সেই ছয় ভুল? এক, পরমাণু চুক্তি নিয়ে মনমোহন-সরকারকে আইএইএ-তে যেতে দিয়েই ভুল করেছিলেন কারাট। যাকে ‘অজুহাত’ করে পরবর্তী কালে মনমোহন-সরকার যুক্তি দেয়, এক বার আইএইএ-তে চলে যাওয়ার পর পরমাণু চুক্তি থেকে সরে আসার আর কোনও সুযোগ নেই। দুই, পরমাণু চুক্তির সঙ্গে সমর্থন প্রত্যাহারের কারণ হিসেবে মূল্যবৃদ্ধির মতো কোনও আমজনতার ইস্যুও রাখা উচিত ছিল। তিন, পরমাণু চুক্তির বিরোধিতার যৌক্তিকতা মানুষকে বোঝানো যায়নি। চার, বামেদের সমর্থন প্রত্যাহারের ফলে সরকার পড়ে যাবে বলে দল নিজের শক্তির ভুল বিচার করেছিল। পাঁচ, বামেদের দীর্ঘদিনের সঙ্গী সপা-কে বুঝিয়ে কংগ্রেস যে শেষ পর্যন্ত আস্থা ভোটে জিতে যাবে, তা-ও সিপিএম নেতৃত্ব আঁচ করতে পারেননি। ছয়, অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি দলগুলিকে নিয়ে কারাট তৃতীয় ফ্রন্টের সরকার গঠনের ডাক দেন। যা লোকসভা নির্বাচনে ‘ব্যুমেরাং’ হয়ে দাঁড়ায়।
সাংগঠনিক ক্ষেত্রেও নিজের দায় এড়াতে পারছেন না কারাট। ২০০৫ সালে দিল্লি পার্টি কংগ্রেসে কারাট সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যকে ‘অগ্রাধিকার তালিকায়’ রাখা হয়েছিল। এ বার সেই রাজ্যে শুধু যে বিধানসভা থেকে সিপিএম মুছে গিয়েছে, তা নয়, সাংগঠনিক শক্তিও কমেছে। দলের একটা বড় অংশের মত হল, এর মূলে রয়েছে জাতপাতের রাজনীতি। উত্তরপ্রদেশ-সহ হিন্দিবলয়ের অধিকাংশ রাজ্যে জাতপাত ও ধর্মের ভিত্তিতেই মানুষ ভোট দেয়। সেখানে সিপিএমের ‘শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্ব’ গুরুত্ব পায় না। এই পরিস্থিতিতে দল কী ভাবে উত্তরপ্রদেশে এগোতে পারে, তা নিয়ে আরও গভীর চিন্তাভাবনার প্রয়োজন বলে দল মনে করছে। ঠিক হয়েছে, অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা পাঁচ রাজ্য ও হিন্দিবলয়ে কী ভাবে বিভিন্ন স্থানীয় ইস্যুতে আন্দোলন গড়ে তুলে জনসমর্থন বাড়ানো যায়, তা ঠিক করতে পার্টি কংগ্রেসের পরে রাজ্য নেতৃত্বগুলির সঙ্গে পৃথক ভাবে বৈঠক করবেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
কিন্তু এ হেন রিপোর্টের পরেও কি পার্টি কংগ্রেসে কারাটের গদি টলে উঠবে? কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতার বক্তব্য, “সমস্যা হল, শুধু কারাট নন, পলিটব্যুরোর অধিকাংশ নেতাই নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে পারছেন না। অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা অন্য রাজ্যগুলি হল অসম, বিহার, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড। অসমের দায়িত্বে ছিলেন বিমান বসু, ঝাড়খণ্ডে বৃন্দা কারাট, বিহারে এস আর পিল্লাই এবং মহারাষ্ট্রে সীতারাম ইয়েচুরি। কোথাও দল কিছু করতে পারেনি।” এই পরিস্থিতিতে কারাট যে ভাবে বিভিন্ন রাজ্যে ‘একলা চলো’ নীতি নিয়ে ধীরে ধীরে সংগঠন গড়ে তোলা ও দলের প্রভাব বাড়ানোর পথে হাঁটতে চাইছেন, তাতে অনেকেই আপত্তি তুলেছেন। তাঁদের যুক্তি, রাজ্যেও আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে হাত মেলানো উচিত। কিন্তু কারাট-শিবিরের পাল্টা যুক্তি, অতীতে এর খেসারত দিতে হয়েছে দলকে। অসম গণ পরিষদ, আরজেডি-র সঙ্গে হাত মেলানোর পরে ওই দলগুলিই লাভবান হয়েছে। উল্টে নিজের রাজনৈতিক জমি ও সমর্থন, দুই-ই হারিয়েছে সিপিএম। |