|
|
|
|
মুলায়মের দল পাশে দাঁড়ালেও কক্ষ ছেড়ে গেল তৃণমূল |
ভোটে জিতেও জোটে উঠল না পাশ নম্বর |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার উপরে ধন্যবাদ প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটির সময় আজ সরকার পাশ নম্বর জোগাড় করে নিল ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে গেল, জোটের অঙ্কে তারা এই মুহূর্তে কতটা দুর্বল।
অথচ, এই ভোটের আগে শরিকদের সঙ্গে সব স্তরে দৌত্য চালিয়েছে মনমোহন সিংহ সরকার। তৃণমূলের আপত্তিকে মেনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন, জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র (এনসিটিসি) গঠন নিয়ে রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত হবে। ডিএমকে-কে খুশি করতে পরক্ষণে জানান, মানবাধিকার রক্ষা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ভোট দেবে ভারত। তাতেও কিন্তু সব দিক রক্ষা হয়নি। ভোটাভুটির সময় লোকসভা ছেড়ে চলে যায় তৃণমূল (যদিও ডিএমকে প্রধান করুণানিধি সন্তোষ প্রকাশ করেন মনমোহনের বক্তৃতায়)। সেই সময় অবশ্য সমাজবাদী পার্টি পাশে দাঁড়ায় সরকারের।
কিন্তু কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের একাংশই এখন বলছেন, যতই মুলায়ম সিংহ যাদব এখন সরকারের পাশে দাঁড়ান, যতই তাঁর সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পর্কের রেখচিত্র এখন ঊর্ধ্বগামী হোক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এখনই ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তার প্রধান কারণ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের খুব বেশি দেরি নেই। সেই ভোটে মুলায়মের সঙ্গে মমতাকেও দরকার। তা ছাড়াও কংগ্রেস নেতৃত্বের কেউ কেউ বলছেন, মুলায়মও যে পরে মমতার মতোই বিভিন্ন বিষয়ে নতুন শর্ত ও আবদার জুড়বেন না, তা কে বলতে পারে? ২০০৮ সালের জুলাইয়ে বামেরা যখন সমর্থন তুলে নেয়, তখনও মুলায়মই ত্রাতা হয়েছিলেন। কিন্তু তার পরে এক বছরের মধ্যে সেই সম্পর্ক যথেষ্ট তিক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। |
|
|
জোট সম্পর্ক ধরে রাখতে হলে
শরিকের ওপর আস্থা রাখতে হয়।
তা না পারলে বলে দিতে হয়,
জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাও।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
যে সব কঠিন সিদ্ধান্ত আমাদের নিতেই হবে, সেগুলো
নেওয়া আরও কঠিন হয়ে যায়। কারণ জোট সরকার
এবং ঐকমত্যের কথা মাথায় রেখে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে
হয় এটা ক্ষুদ্র দলগত স্বার্থ পরিত্যাগ করার সময়।
মনমোহন সিংহ |
|
এই পরিস্থিতিতে আজ তৃণমূলের কক্ষত্যাগ জোটের জীর্ণ চেহারাটাই সামনে আনছে বলে মনে করছেন সকলে।
শুধু তাই নয়, দিল্লিতে মমতার এ দিনের বক্তব্যও তাৎপর্যপূর্ণ। রেলমন্ত্রী পদে মুকুল রায়ের অভিষেক সুনিশ্চিত করে (মঙ্গলবার সকাল ১০টায় শপথ) তিনি জানিয়ে দিলেন, “সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করতে চাই না ঠিকই। কিন্তু অপমানও সহ্য করব না।” সেই সঙ্গে এ-ও বলেন, “প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা যদি সনিয়া গাঁধী স্থির করতে পারেন, তা হলে রেলমন্ত্রী বাছার অধিকার আমারও রয়েছে।”
আর এ দিনই লখনউতে বসে সমাজবাদী পার্টি নেতা মুলায়ম সিংহ বলেন, “কেন্দ্রে সামিল হওয়ার প্রস্তাব সপা-কে কেউ দেয়নি। সপা দরবারও করেনি। তবে কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন দিয়ে যাবে সমাজবাদী পার্টি।”
আজ সকাল থেকে সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল সংসদের দিকে। বাজেট অধিবেশনের শুরুতে রাষ্ট্রপতি যৌথ সভায় যে বক্তৃতা দেন, তার ধন্যবাদ প্রস্তাবে ভোটাভুটির বিশেষ দৃষ্টান্ত নেই। বিরোধীরা প্রতিবারই সংশোধনী আনেন, কিন্তু অধিকাংশ সময়েই কেবল ধ্বনি ভোটে প্রস্তাব পাশ হয়ে যায় ও খারিজ হয়ে যায় সংশোধনী। কিন্তু প্রথমে উত্তরপ্রদেশের ভোটে কংগ্রেসের বিপর্যয় ও পরে রেল বাজেট নিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে তাদের টানাপোড়েনই আজ অনিবার্য করে তোলে ভোটাভুটি। আর সেই ভোটাভুটির আগে তৃণমূল যখন লোকসভা ত্যাগ করে সরকারের অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে তোলে, তখন সরকারের পক্ষে ভোট দেয় সমাজবাদী পার্টি। শেষমেশ অবশ্য ‘ফটোফিনিশ’ হয়নি। বরং বিরোধীদের (১৪১টি) তুলনায় সরকারের (২২৭টি) পক্ষে ৭৬টি ভোট বেশি পড়ে। ভোটাভুটিতে বিরত থেকে মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টিও সরকারকে কিছুটা সুবিধা করে দেয়।
তবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মতে, সামগ্রিক এই চিত্র থেকেই স্পষ্ট যে, সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে কতটা কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে সরকারকে। কেন্দ্রে ইউপিএ জোটের ভঙ্গুর ছবিটাও ধরা পড়েছে লোকসভায়। বস্তুত, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও আজ কার্যত সেই দুর্বলতার কথাটাই স্বীকার করে নিয়েছেন। বলেছেন, “এটা নিশ্চয়ই সকলেই বুঝতে পারছেন যে, জোট সরকার চালাতে গিয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া কী ভাবে জটিলতর হয়ে পড়ছে। ঐকমত্য গড়ে চলতে হচ্ছে।” সেই চ্যালেঞ্জ কতটা, তা সম্প্রতি রেল বাজেট পর্বই তুলে ধরেছে।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের মতে, এই চিত্রের দু’টি দিক রয়েছে। প্রথমত, কংগ্রেস-তৃণমূল সম্পর্কের অবনতি যে হচ্ছে, তা এখন স্পষ্ট। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম সংসদে এলেন মমতা। অথচ সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎই হল না। যা কি না ছিল জোট সম্পর্কের দাবি। উল্টে সংসদের বাইরে সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় কংগ্রেসকে তুলোধনা করলেন মমতা। বললেন, “জোট সম্পর্ক ধরে রাখতে হলে শরিকের ওপর আস্থা রাখতে হয়। তা না পারলে বলে দিতে হয়, জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাও।”
মমতা যখন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক, তখন দেখা গেল, প্যাভিলিয়নে প্যাড পরে বসে আছেন সমাজবাদী পার্টি নেতা মুলায়ম সিংহ। তৃণমূল যত ক্ষণ মন্ত্রিসভায় রয়েছে তত ক্ষণ সপা-র পক্ষে সরকারে যোগ দিলে প্রাপ্তির সম্ভাবনা কম। কিন্তু মুলায়মের এ-ও অজানা নয় যে, মমতা সমর্থন তুলে নিলে তিনি যদি ইউপিএ-র শরিক হন, তা হলে উত্তরপ্রদেশে সপা সরকারেরও মঙ্গল হতে পারে।
তবে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা এখনও মনে করছেন, আপাতত মমতাকে বুঝিয়ে সঙ্গে রাখার পাশাপাশি মুলায়মকেও হাতের পাঁচ হিসেবে রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
লোকসভায় এ দিন কী হয়েছে? রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় এনসিটিসি-র উল্লেখ নিয়ে আগেই আপত্তি জানায় তৃণমূল। লোকসভায় তাদের সংশোধনী প্রস্তাব প্রক্রিয়াগত ত্রুটির কারণে খারিজ হয়ে যায় ঠিকই। কিন্তু সরকারের সঙ্কট অনুধাবন করে ওই একই বিষয়ে সংশোধনী এনে আজ ভোটাভুটি দাবি করে বাম-বিজেপি। সরকারের অস্বস্তি বাড়াতে এনসিটিসি-র পত্তন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে যে চিঠি পাঠান মমতা, তা পড়ে শোনান লোকসভার বিরোধী দলনেতা সুষমা স্বরাজ। সরকারের অস্বস্তি এখানেই থেমে থাকেনি। কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়ার কারণে, এ ব্যাপারে আজ তৃণমূল কেন্দ্রের বিরুদ্ধাচরণ করেনি ঠিকই। কিন্তু ধ্বনি ভোটে সংশোধনের বিপক্ষে সুর চড়িয়ে প্রকৃত ভোটাভুটির আগে লোকসভা থেকে কক্ষ ত্যাগ করেন তৃণমূল সাংসদ ও মন্ত্রীরা। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়ের মতো সরকারের মন্ত্রীদের কক্ষ ত্যাগ করা নিয়েও বিজেপি-বামেরা প্রশ্ন তোলে। বলা হয়, তার মানে কি মন্ত্রিসভার সদস্যদেরই সরকারের ওপর আস্থা নেই?
যদিও পরে এই কক্ষত্যাগের ব্যাখ্যা দিয়ে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ওয়াক আউট করিনি। কেবল ভোটাভুটিতে অনুপস্থিত থেকেছি।” সেই ব্যাখ্যা যে সকলে গ্রহণ করেছেন না। বরং শরিকের এই আচরণ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে কংগ্রেসকেও। সরকারের ভিতর এই টানাপোড়েন স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপিকে ঘর গোছানোর সময় দিচ্ছে। সরকার যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় ২৭২ জন সাংসদকে লোকসভায় উপস্থিত রাখতে পারেনি, তা নিয়েও কটাক্ষ করেছে বিজেপি। সুষমার কথায়, সরকার যে সংখ্যালঘু, তা এখন প্রমাণিত। তবে সংসদের মধ্যে সরকারের এই দুর্বলতা মানুষের সামনে তুলে ধরে বিজেপি কতটা ফসল ধরে তুলতে পারবে, সেই প্রশ্ন থাকছেই। পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে, সেটা অবশ্য ভবিষ্যৎই বলবে। |
|
|
|
|
|