আজ মমতাকে সরাসরি প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনি কি একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্লাব তৈরি করার চেষ্টা করছেন?’ জবাবে মমতা বলেন, “এই যে সেন্ট্রাল হলে বসে আছি, এটাই তো একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্লাব। আমাদের সংবিধানের প্রণেতারা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রণয়ন করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীরা সেই কাঠামোর অঙ্গ। ফলে আলাদা করে ক্লাব তৈরির প্রশ্ন উঠছে কী করে!” উল্টে মমতার বক্তব্য, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষা করার জন্যই তাঁদের এই তৎপরতা। এর পিছনে কোনও রাজনীতি নেই। নীতীশ কুমারও বলেছেন, “তৃতীয় ফ্রন্ট তৈরির চেষ্টার কথাটা গল্পের গরুর গাছে ওঠা। রাজ্যের অনুন্নয়ন রুখতে একজোট হওয়াটাই আপাতত লক্ষ্য।”
আজ সেন্ট্রাল হলে বা প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে সব প্রসঙ্গ মমতা তুলেছেন, তার সবটাই রাজ্যের অধিকার কেন্দ্রিক। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ দেগে বলেছেন, রাজ্যের সামনে অর্থনৈতিক অবরোধ তৈরি করতে চাইছে এই সরকার। আবার জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র (এনসিটিসি) গড়ার প্রস্তাবকে টাডা বা পোটা-র চেয়েও ভয়ঙ্কর ঘটনা বলে আখ্যা দিয়েছেন। অনুযোগ করে বলেছেন, “আমরা যখনই কোনও বিষয়ে সরব হই, তখনই বড় দলগুলি অভিযোগ করে ব্ল্যাকমেল করছি। আমাদের যতটা সম্মান করা হয়, তার চেয়ে বেশি অপমান করা হয়।”
প্রবীণ রাজনীতিকদের অনেকেই বলছেন, মমতার যা উদ্বেগ, তা বেশির ভাগ মুখ্যমন্ত্রীরই মাথাব্যথা। লোকসভায় বিজেডি সাংসদ ভর্তৃহরি মহতাবের বক্তৃতা শুনেই যে মমতা লোকপাল বিলের আওতায় রাজ্যে লোকায়ুক্ত করার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে ওই বিশ্লেষকেরা বলছেন, সিপিএম সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট যে অর্থে অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি তৃতীয় বিকল্প গড়ার কথা ভাবছেন, তার সঙ্গে মমতাদের এই জোটের কোনও মিল নেই। এটাকে বরং ‘মুখ্যমন্ত্রীদের ট্রেড ইউনিয়ন’ আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। এখানে দলীয় রাজনীতির রং বিচার্য নয়। বিচার্য দাবির ঐক্য। শ্রমিক স্বার্থরক্ষার দাবি নিয়ে কংগ্রেসের আইএনটিইউসি, বিজেপি-র বিএমএস, সিপিএমের সিটু যেমন এক সঙ্গে লড়াই করে, এটাও অনেকটা সেই রকম। মমতাদের এই লড়াইটা ইউপিএ-র বিরুদ্ধে নয়। রাজ্যগুলির স্বার্থরক্ষায় কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে। ঘটনাচক্রে যে সরকার ইউপিএ-র এবং যার নেতৃত্বে কংগ্রেস। ক্ষুদ্র দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ দূরে সরিয়ে রেখেই রাজ্যের দাবি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে লড়াই করার কর্মসূচি নিয়েছে ‘মুখ্যমন্ত্রীদের ক্লাব’।
বাজেটের মুখে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে নীতীশ কুমার আর্জি জানিয়েছিলেন, শুধু বিহার নয়, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ডের মতো পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির জন্য সামগ্রিক আর্থিক সহায়তার রূপরেখা চাই কেন্দ্রীয় বাজেটে। তাঁর যুক্তি, পূর্বাঞ্চল দীর্ঘদিন বঞ্চিত হয়েছে। পঞ্জাবে যদি কেন্দ্রীয় সাহায্যে সবুজ বিপ্লব হতে পারে, তা হলে পূর্বাঞ্চলে যেখানে মাটি এত উর্বর, ফলন এত ভাল, সেখানে হবে না কেন! কেন সে জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে না কেন্দ্র?
নীতীশের সেই আর্জি পূরণ হয়নি। ফলে এ নিয়ে কেন্দ্রের উপরে চাপ বাড়াতে পড়শি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। যাতে সামিল হয়ে পূর্বাঞ্চলের সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য খুব শীঘ্রই বিহারের মুখ্যমন্ত্রীকে পশ্চিমবঙ্গে আমন্ত্রণ জানাবেন মমতা। নবীন পট্টনায়কও খোলাখুলিই এই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছেন।
মমতা ভালই জানেন যে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন না-হওয়া পর্যন্ত কংগ্রেসের পক্ষে কোনও শরিককে (এমনকী সমর্থক সপা, বিএসপি-কে) চটানো সম্ভব নয়। ফলে কেন্দ্রের কাছ থেকে দাবিদাওয়া আদায়ের এটাই সব চেয়ে ভাল সময়। বস্তুত ডিএমকে-কে ‘খুশি’ রাখতে আজই সংসদে প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, রাষ্ট্রপুঞ্জে তামিল-নিধন নিয়ে আনা প্রস্তাবে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ভোট দেবে ভারত। এই প্রসঙ্গের উল্লেখ করে মমতা বলেন, “তামিলনাড়ুতে তো ওদের দাবি মেনে নিয়েছে। আগে মানেনি কেন? শ্রীলঙ্কা নিয়ে তামিলনাড়ুর বন্ধুরা যেমন ভাল জানেন, বাংলাদেশ নিয়ে তেমন আমি ভাল জানি।”
বিশদে না-বললেও তাঁকে ‘অন্ধকারে’ রেখে কেন্দ্র বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি করার পথে এগোনোয় তিনি যে ক্ষুব্ধ, এই মন্তব্যের মাধ্যমে সেটা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তবে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জেহাদ আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা যে হবে, সেটা মমতা ভালই জানেন। আর সেই কারণেই আজ তিনি ফের স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করবেন না। তবে আত্মসম্মান বজায় রেখেই শাসক জোটে থাকতে চান তিনি। মমতার কথায়, “সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই ভাল। এ নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। আর কংগ্রেসের সঙ্গে আমার কোনও ইগোর সমস্যাও নেই। তবে আমাদের সম্মান দিতে হবে। কংগ্রেস বড় দল। কিন্তু শরিকদের সম্মান তো করতে হবে।”
কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক যে তিনি কোনও ভাবেই তিক্ত করতে চান না, সে কথাও আজ বুঝিয়ে দিয়েছেন মমতা।
সেন্ট্রাল হলে যখন তিনি তুমুল আড্ডায় ব্যস্ত, তখন খানিকটা দূরে দূরেই ছিলেন কংগ্রেস মুখপাত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি। ভিড় একটু হাল্কা হতে রসিকতা করে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি কি আজ কংগ্রেস সাংসদদের সঙ্গে কথা বলছেন? তা হলে আমি একটু বসতাম।” মমতাও হাসতে হাসতে জবাব দেন, “ব্যক্তিগত সম্পর্কের সঙ্গে আমি কখনও রাজনীতি জড়াই না।”
তবে মমতার উদ্যোগের পিছনে এখনও কংগ্রেস-বিরোধী কিছু নেই স্বীকার করে নিয়েও কিঞ্চিৎ আশঙ্কিত কংগ্রেস শিবির। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশের মতে, এই প্রক্রিয়াটি চালাতে চালাতে ভবিষ্যতে যদি কোনও রাজনৈতিক জোট বা নির্বাচনী আঁতাঁতের সম্ভাবনা তৈরি হয়, তখন মমতা বা নীতীশ বা অখিলেশ সে ব্যাপারে সক্রিয় হবেন। আর সেই সম্ভাবনায় আজ থেকেই ইন্ধন দিতে শুরু করেছে বিজেপি। দলীয় সাংসদ বিজয় গোয়েল আজ মমতাকে বলেন, “আপনি এনডিএ-তে ফিরে আসুন। আমরা ছোট থেকে বড় দল হয়েছি। আমরা শরিকদের মর্যাদা দিতে জানি।” আর ঠিক এখানেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।
সিপিআই নেতা গুরুদাস দাশগুপ্তের সঙ্গেও আজ অনেক ক্ষণ কথা হয় মমতার। ঘটনাচক্রে আজই দীনেশ ত্রিবেদীর অপসারণ প্রসঙ্গে লোকসভায় গুরুদাসবাবু বলেন, কোনও মন্ত্রীকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার অধিকার দলের রয়েছে। বামেরা যেমন স্পিকার পদ থেকে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল। মমতাকে সে কথা জানিয়ে গুরুদাসবাবু বলেন, রাজ্যের পক্ষে ন্যায়সঙ্গত যে সব দাবি উঠবে, তিনি ব্যক্তিগত ভাবে অন্তত সেগুলি সমর্থন করবেন।
কিন্তু সিপিএমের সমস্যা হল, মমতা-নীতীশের এই নতুন রাজনীতিতে তারা সামিল হতে পারছে না। ত্রিপুরা একমাত্র রাজ্য যেখানে সিপিএম ক্ষমতায়। আবার কমিউনিস্ট মতাদর্শের দিক থেকে তারা শক্তিশালী রাষ্ট্রগঠনের পক্ষে। এমনকী দলীয় সংবিধানে এখনও সিপিএম সর্বহারার একনায়কতন্ত্র স্থাপনের লক্ষ্যের কথাই বলে। রাজ্যের প্রতি বিমাতৃসুলভ মনোভাবের অভিযোগ তুলে সিপিএম অতীতে কেন্দ্র-বিরোধী রাজনীতি করলেও রাজ্যের স্বাধিকার প্রশ্নে যখন যোজনা কমিশনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার কথা বলা হয়, তখন মতাদর্শগত ভাবে তা তারা সমর্থন করতে পারে না।
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন লালুপ্রসাদ যাদব যখন তাঁর রাজ্যের জন্য আলাদা ব্যাঙ্ক গঠনের দাবি জানিয়েছিলেন, তখন তাঁর মিত্র হয়েও এতটা স্বাধিকারের দাবিকে সমর্থন জানায়নি সিপিএম। সিপিএম সূত্রের বক্তব্য, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই বিকল্প অর্থনৈতিক মডেল আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে জোট বাঁধতে গেলেও বিকল্প অর্থনৈতিক মতাদর্শগত ভিত্তির উপরেই তা গড়তে হবে বলে জানিয়েছিল তারা।
মমতা-নীতীশ-অখিলেশ-নবীন আপাতত তাই রাজনৈতিক জোট বাঁধার জন্য তাড়াহুড়ো না করে সুসংহত ভাবে রাজ্যগুলির দাবিদাওয়া দিল্লির দরবারে পৌঁছে দিতে চাইছেন। যে লক্ষ্যে সংসদ চলাকালীন মাসে অন্তত এক বার করে সেন্ট্রাল হলে আসবেন বলে আজই ঘোষণা করে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। |