পুরুলিয়া জেলার অর্ধেক ব্লকেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্তর্বিভাগ চালু করা যায়নি। একই অবস্থা এই জেলার জঙ্গলমহলেও। এর ফলে মামুলি রোগ হলেও মানুষজনকে বড় হাসপাতালেই ছুটতে হচ্ছে। অথচ স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশ রয়েছে, প্রতিটি ব্লকে অন্তত একটি করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্তর্বিভাগ চালু রাখতে হবে। কার্যক্ষেত্রে স্বাস্থ্য দফতর সেই নিয়ম না মানায় বাসিন্দারা ক্ষুদ্ধ। জেলাশাসক অবনীন্দ্র সিংহ বলেন, “চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে। গত বছর ২০ জন চিকিৎসক পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু তাঁদের মধ্যে মাত্র ছ’জন কাজে যোগ দেন। বাকিরা আসেননি।”
পুরুলিয়া জেলার উপমুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক আজিজুর রহমান বলেন, “প্রতিটি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অধীনে নিদেন পক্ষে অন্তত একটি করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্তর্বিভাগ চালু রাখতে হবে বলে স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু চিকিৎসক থেকে স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব ও নানা সমস্যার কারণে অনেক ব্লকেই এখনও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্তর্বিভাগ পরিষেবা চালু করা সম্ভব হয়নি।” জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, পুরুলিয়া জেলায় ২০টি ব্লকের মধ্যে ১০টি ব্লকে কোনও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই অন্তর্বিভাগ নেই। এই ব্লকগুলি হল: পুঞ্চা, পুরুলিয়া ১, রঘুনাথপুর ১ ও ২, নিতুড়িয়া। একই অবস্থা জঙ্গলমহলের জয়পুর, ঝালদা, কোটশিলা, আড়শা, বলরামপুর ব্লকেও। ওই এলাকার বাসিন্দাদের বড় ভরসা ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কারণ দুপুরের পরে অনেক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা থাকেন না বলে অভিযোগ। বাসিন্দারা জানান, রাত-বিরেতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনও চিকিৎসা মেলে না। তখন ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ছুটতে হয়। দুর্গম এলাকায় ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় ওই এলাকার বাসিন্দাদের সমস্যা আরও বেশি।
রাজ্য সরকার মাওবাদী উপদ্রুত এলাকায় নানা উন্নয়নমূলক কাজের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় জোর দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু ওই সব এলাকার বাসিন্দাদের প্রশ্ন, “সরকার তাহলে আমাদের এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে অন্তর্বিভাগ চালু করছে না কেন?” বর্তমান রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছে, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ছোট হাসপাতাল থেকে বড় হাসপাতালে রোগী স্থানান্তর কমাতে হবে। কিন্তু, স্বাস্থ্যকেন্দ্র গুলিতে ছোটখাটো রোগের চিকিৎসা না করা হলে রোগী স্থানান্তরের ঘটনা যে কমানো সম্ভব নয়, তা অনেক চিকিৎসকেরাই মেনে নিয়েছেন। জেলার এক স্বাস্থ্য কর্তার কথায়, “অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এমন অনেক রোগী আছেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাঁরা সামান্য চিকিৎসাটুকু পাননি। কিছু দিন সেখানকার অন্তর্বিভাগে রোগীটিকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করালে অবস্থার উন্নতি হত। কিন্তু তা না হওয়ায় বা দূরের ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তিনি চিকিৎসা করাতে না যাওয়ায়, পরে সেই রোগ আরও জটিল হয়ে পড়েছে। পরবর্তীকালে সেই সব রোগীদের বড় হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হয়। এর ফলে হাসপাতালগুলির চাপ বাড়ছে।”
জেলা মূখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক নিশিকান্ত হালদার স্বীকার করেন, “এমন কয়েকটি ব্লক রয়েছে যেখানে একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও অন্তর্বিভাগ নেই। আবার এমন ব্লকও রয়েছে, যেখানে একাধিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্তর্বিভাগ চালু আছে। প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মী কম থাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে ওই পরিষেবা দেওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া পরিকাঠামোগত সমস্যাও রয়েছে।” স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, কোটশিলা ব্লকের অধীনে বেগুনকোদর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির অন্তর্বিভাগ দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার পরে দুর্গাপুজোর পরে কয়েকমাস চালু ছিল। চিকিৎসেকর অভাবে ফের সেখানকার অন্তর্বিভাগ গুটিয়ে ফেলতে হয়েছে। বাসিন্দারা জানিয়েছেন, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে আবেদন জানিয়েও কোনও সুরাহা হয় নি। পুঞ্চা ব্লকের বাগদা কেন্দ্রটির অন্তর্বিভাগ চালুর দাবিতে বাসিন্দারা সম্প্রতি পথ অবরোধ করেন। আবার জয়পুর ব্লকের সিধি ও পুরুলিয়া ২ ব্লকের চয়নপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র দু’টি প্রায় এক দশক ধরে বন্ধ রয়েছে। এখন চারপাশে আগাছা তৈরি হয়েছে। পুরুলিয়ার সহকারী মুখ্যস্বাস্থ্য আধিকারিক কেপি সর্দার বলেন, “ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র দু’টি সংস্কার করা দরকার। তারপরে চিকিৎসা শুরু করা হবে।
জেলার উপমুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক আজিজুর রহমান বলেন, “জেলায় ৩০০ জন ডাক্তারের পদ অনুমোদিত থাকলেও ৮০ জন চিকিৎসক নেই। ২০০৩ সালে শেষবার জেলায় ফার্মাসিস্ট নিয়োগ হয়েছে। এ ছাড়া নার্স ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর অভাব রয়েছে।” দফতরের এক পদস্থ কর্তা বলেন, “কয়েকটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এমন প্রত্যন্ত এলাকায় রয়েছে যে মহিলা কর্র্মীরা ওই এলাকায় যেতে ভরসা পান না। ওই সব কেন্দ্রে মহিলা কর্মীদের থাকার মত পরিকাঠামো গড়ে তোলা যায়নি।” জেলাশাসকও বলেন, “পুরুলিয়ার নাম শুনে অনেকেই চাকরি করতে আসতে চাইছেন না। আমরা পরিস্থিতি পাল্টানোর চেষ্টা করছি। স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গেও চিকিৎসক পাঠানোর জন্য আলোচনা চলছে।” |