নিজস্ব সংবাদদাতা • আলিপুরদুয়ার |
গোটা বাড়ি সারাক্ষণ কলকল করছে একপাল শিশুর ভিড়ে। একজন হাতে বই নিয়ে বাড়ির মালিককে সমানে একটির পর একটি প্রশ্ন করছে তো অন্যজন বেড়াতে যাবে বায়না ধরেছে। কেই বায়না ধরেছে, এখনই তার রঙতুলি চাই। বাড়ির মালিক কালচিনির বিডিও থেনডুপ শেরপা হাসিমুখে সবার বায়না সামলাচ্ছেন। যদিও এই শিশুর দঙ্গলের একজনও তাঁর নিজের সন্তান নয়। কাউকে বক্সার আদমা পাহাড়, কাউকে নিয়ে এসেছেন শেওগাঁও এলাকা থেকে। বক্সার দুর্গম ওই সমস্ত এলাকায় বেশির ভাগ গ্রামে সরকারি স্কুল নেই। যেখানে স্কুল আছে, সেখানে শিক্ষক মেলে না। সমতলের শিক্ষকেরা প্রত্যন্ত ওই স্কুলে যেতে চান না। আবার ওই সমস্ত পাহাড়ি গ্রামের তরুণ তরুণীদের যে শিক্ষাগত যোগ্যতা তাতে তাঁরা আবেদন করেও সরকারি স্কুলে চাকরি পান না। যে সমস্ত পরিবারের সামর্থ্য রয়েছে তাঁদের ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার হেঁটে অথবা হস্টেলে থেকে আলিপুরদুয়ার কিংবা কালচিনিতে পড়াশোনা করছে। দুঃস্থ পরিবারের ছেলেমেয়েদের ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে কালচিনির বিডিও। বক্সা পাহাড়ের ওই সমস্ত গ্রামের ছেলেমেয়েদের সমস্যা মেটাতে দীর্ঘ সময় লাগবে বুঝে ওই সমস্ত শিশুদের নিজের কালচিনির সরকারি কোয়ার্টারে এনে তুলেছেন। বিডিও’র ওই সরকারি কোয়ার্টারে থেকে ১০ জন শিশু পড়ছে। শুধু তাই নয়, আরও পাঁচটি শিশুকে বিডিও পকেটের পয়সা খরচ করে দার্জিলিঙে নিজের বাড়িতে রেখে পড়াশোনা করাচ্ছেন। বিডিও’র ওই ভুমিকায় বিস্মিত জলপাইগুড়ির জেলাশাসক স্মারকী মহাপাত্রও। তিনি বলেন, “অত্যন্ত একটা ভাল কাজে হাত দিয়ছেন বিডিও। অন্যদের শেখা উচিত। প্রত্যন্ত এলাকার ছেলেমেয়েদের নিজের সরকারি কোয়ার্টারে রেখে পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। উনি আরও বেশ কিছু ভাল কাজ করছেন বলেও শুনেছি। গ্রামে গিয়ে ক্যাম্প করে লোকজনকে সরকারি প্রকল্প সম্পর্কে অবগত করছেন। এই ঘটনা অন্যদের অনুপ্রাণিত করলে খুশি হব।” |
বক্সা পাহাড়ে শিক্ষা প্রসারের সমস্যা মেটাতেও যে জেলা প্রশাসন উদ্যোগী হয়েছে সেই ব্যাপারেও দাবি করেছেন জেলাশাসক। তিনি বলেন, “আদমায় স্কুল থাকলেও কোনও শিক্ষক যান না বহু বছর। সেখানকার শিশুদের শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। কালচিনির বিডিও উদ্যোগী হয়ে আদমা গ্রামে সরকারি ভাবে একটি স্কুল ও হস্টেল তৈরির প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। স্কুলটি হলে পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকার শিশুরা সেখানে থেকে পড়াশোনা করতে পারবে। ওই এলাকার শিক্ষিত তরুণ তরুণীদের স্কুলে চাকরি দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। তাহলে সমতল থেকে শিক্ষক পাঠানোর সমস্যা থাকবে না।” কালচিনির বিডিও’র সরকারি কোয়ার্টারে গেলে মনে হবে যেন গোটা বাড়িটাই একটি হস্টেল। গোটা বাড়িতে খাট কিংবা চৌকির চিহ্নমাত্র নেই। শোয়ার জন্য ঘরে ঘরে মেঝেয় বিছানা পাতা। ছোট ছেলেমেয়েগুলির সঙ্গে বিডিও নিজেও মেঝেয় পাতা বিছানায় ঘুমান। প্রত্যেকের জন্য নিজে হাতে রান্না করছেন। সহজ, সরল মেনু। রেশনের চাল এবং সয়াবিনের তরকারি। ফালাকাটার ডলি বর্মন, আদমার সোনম লামা, দিজেন ডুকপা, খান্ডুলাম ডুকপা, পচু ডুকপা, দাওয়া লামাদের দেখলে অবশ্য বোঝা যাবে মহা সুখেই রয়েছে তারা। বিডিও বলেন, “খুব সাধারণ জীবন যাপন করা অভ্যাস। মাটিতে বিছানা করে শুই। রেশনের চাল নিজে রান্না করে সয়াবিনের তরকারি দিয়ে খাই। বাচ্চাদেরও খাওয়াই। বক্সার আদমা গ্রামে গিয়ে দেখি এলাকায় স্কুল থাকলেও বহু বছর ধরে শিক্ষকরা সেখানে যান না। আদমা, শেওগাঁও সহ বেশ কয়েকটি পাহাড়ের প্রত্যন্ত গ্রামে শিক্ষার আলো পৌঁছয়নি। কয়েক দফায় প্রায় ১৪ জন বাচ্চাকে কালচিনি, দার্জিলিঙে নিয়ে গিয়ে স্কুলে ভর্তি করেছি। দশ জন আমার কালচিনির সরকারি আবাসনে থাকে।” ফালাকাটার ডলি বর্মনকে তার পরিবারের লোকেরা আলিপুরদুয়ারের মহকুমাশাসকের দফতরে নিয়ে এসেছিলেন। পরিবারটির আর্থিক অবস্থা খারাপ। খবর পেয়ে বিডিও তাঁকেও নিজের কাছে নিয়ে আসেন। কালচিনির একটি স্কুলে ডলি ক্লাস টু’তে পড়ে। বিডিও’র স্ত্রী ছাড়াও দুই মেয়ে এবং এক ছেলে। তাঁরা সকলেই দার্জিলিঙে থাকে। বিডিও বলেন, “আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়েরাও আমায় এই কাজে মাঝে মাধ্যে সাহায্য করে। প্রতি শনিবার ও রবিবার আমি যেখানে যাই, ওই শিশুদের নিয়ে ঘুরি। তাদের এলাকা চেনানো ও কোথাও প্লাস্টিক পড়ে থাকলে তা কুড়িয়ে নির্দিষ্ট স্থানে রাখি। প্রকৃতি সংরক্ষণের পাঠ শেখানোর চেষ্টা করি।” |