আপাতত ‘ব্রেকিং পয়েন্ট’ নয়! বরং ‘ব্রেকিং নিউজ’!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানার দশম মাসে দাঁড়িয়ে বিরোধী সিপিএমের নীতি এখন এটাই!
সাম্প্রতিক কালে একের পর এক ঘটনায় মমতার নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের ‘ভাবমূর্তি’তে ধাক্কা লাগলেও এখনই সরকারের সঙ্গে হেস্তনেস্ত করার সময় আসেনি বলেই মনে করছে আলিমুদ্দিন। দলের কর্মী-সমর্থকদের প্রতি সিপিএম নেতৃত্বকে আরও বেশি করে হুঁশিয়ারি দিতে হচ্ছে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় এখনও আসেনি। বরং কালের নিয়মে, সংবাদমাধ্যম মারফত রাজ্য সরকার এবং প্রধান শাসক দলের যে সব কাণ্ড-কারখানা সামনে আসছে, আসতে দাও! লোকে যা বোঝার, বুঝে নেবে!
কী ভাবে রাজ্য সরকার এবং শাসক দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভের রসদ জমছে, বর্ধমান এবং যাদবপুরের ঘটনার প্রেক্ষিতে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে বিশেষ ভাবে তা আলোচনা হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি সামান্য ঘুরছে দেখেই নিচু তলার কর্মী-সমর্থকেরা যাতে ‘সংযম’ না-হারান, সে দিকে নজর রাখার কথা ভাবতে হচ্ছে রাজ্য নেতৃত্বকে। প্রাথমিক ভাবে, আলিমুদ্দিন আরও তিন মাস সময় ধরে রাখছে হাল্কা প্রচারের জন্য। সিপিএমের বক্তব্য, ব্রিগেড সমাবেশ এবং সাধারণ ধর্মঘটের কর্মসূচিতে ‘সাফল্য’ এসেছে। আপাতত তাদের বড় কোনও কেন্দ্রীয় কর্মসূচি নেই। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য শব্দবিধি বলবৎ থাকায় এমনিতেই প্রকাশ্য কর্মসূচি নেওয়ার অসুবিধা। তার উপর এপ্রিলে দলের পার্টি কংগ্রেস। এই সময়টা মিছিল, ছোট সভার মতো ‘আপাত-নিরীহ’ কর্মসূচিতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছে সিপিএম।
দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “মাথায় রাখতে হবে, ব্রেকিং পয়েন্ট এখনও আসেনি। এই সরকার এসেছে পাঁচ বছরের জন্য। আরও কত কিছু হবে! আমাদের কর্মীদের এমন কিছু করা চলবে না যাতে মনে হয়, আমরা অধৈর্য হয়ে পড়েছি।” সরকার তথা শাসক পক্ষকে ‘চেপে ধরা’র জন্য নিচু তলার চাপ প্রবল। যেমন, দলীয় সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো আকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ট্রাফিক সার্জেন্টের গায়ে হাত তুলেও প্রাথমিক ভাবে ছাড় পেয়ে যাওয়ায় স্থানীয় সিপিএম নেতা-কর্মীরা প্রতিবাদে রাস্তায় নামতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজ্য নেতৃত্ব তাঁদের নিরস্ত করে বলেন, কংগ্রেস অবিলম্বে রাস্তায় নেমে পড়েছে। এতে সিপিএম না-থাকলেই আখেরে ভাল হবে। যাদবপুরের ঘটনাতেও সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদে যেতে চেয়েছিল দলের একাংশ। আলিমুদ্দিন থেকে বার্তা পাঠানো হয়, তাড়াহুড়ো নয়। পর দিন গুছিয়ে মিছিল হবে।
রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের মতে, “তৃণমূল চাইবে পঞ্চায়েত ভোট ঘিরে একটা সন্ত্রস্ত পরিবেশ তৈরি করতে। এমনিতেই আইনশৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে। আমরা সংযত না-থাকলে তো রাজ্যে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হবে! তাতে রাজ্যের ক্ষতি, আমাদেরও ক্ষতি।” সালুয়ার ঘটনাকে রাজ্যের ‘অগ্নিগর্ভ’ পরিস্থিতির সূচক বলে মনে করছেন সিপিএম নেতৃত্ব। ওই নেতার কথায়, “সৌভাগ্যের কথা, সালুয়ার সংঘর্ষে সিপিএমের হাত পাওয়া যায়নি! আমাদের এখনকার নীতি হল, সরকার এবং তার নেতাদের মুখোশ যত পারো খুলে দাও! যে সব অসত্য কথা বলে ওঁরা এত দিন পার পেয়ে গিয়েছেন, এখন সেগুলো লোকের চোখে ধরা পড়বে। আমাদের যে কথাগুলো বিশ্বাস করতে চাইছিলেন না মানুষ, সংবাদমাধ্যমে দিনের পর দিন সেগুলোই দেখতে দেখতে তাঁরা সব বুঝতে পারছেন।” সিপিএম তা হলে আপাতত কী করবে?
এক প্রাক্তন মন্ত্রীর কথায়, “বিধানসভার কক্ষকে ব্যবহার করব। সরকারের কথা ও কাজের ফারাক ধরিয়ে দেব। আর বাইরে কর্মীদের সংযত থাকতে বলব। শাসক পক্ষের স্বরূপ ধরা পড়ুক, এটাই এখন লক্ষ্য।” এই লক্ষ্যে সিপিএম চাইছে মিছিলের মতো কিছু কর্মসূচি নিতে। মিছিলে নেতারা উপস্থিত থাকলে (যাদবপুরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা রাজারহাটে বিমান বসু) এক দিকে যেমন দলের কর্মীদের ‘ক্ষোভ’ সামলানো যায়, তেমনই উপরি লাভ তৃণমূলের পাল্টা কর্মসূচি। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলছেন, “আর্থিক বছরের শেষে ফেব্রুয়ারি-মার্চ হচ্ছে মন্ত্রীদের মুখ গুঁজে কাজ করার সময়। তখন মন্ত্রীরা যদি আমাদের পাল্টা করতে ঘুরে বেড়ান, তাতে কার লাভ?”
তবে এ সবের মধ্যেও কর্মীদের প্রতি প্ররোচিত না-হওয়ার ‘নির্দেশ’ জারিই রাখতে হচ্ছে আলিমুদ্দিনকে। রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবু যেমন দলের তাত্ত্বিক মুখপাত্রের সাম্প্রতিক সংখ্যায় লিখেছেন, ‘কোনও ভাবেই ভীত-সন্ত্রস্ত না-হয়ে, কোনও প্ররোচনার ফাঁদে পা না-দিয়ে বা হঠকারী কোনও কর্মসূচি না-নিয়ে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হয়ে এই অবস্থা পরিবর্তনের লড়াইতে নিজেদের সঁপে দিতে হবে’। কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের বক্তব্য, “আমাদের এখন ঘর গোছানোর সময়। কিন্তু সরকারের কাজকর্মের জন্যই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলানোর ইঙ্গিত আসছে। এখন আমাদের প্রতিক্রিয়া হতে হবে মাপা। ঠিক যে কাজটা বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র করছেন।”
ব্রিগেডে স্লোগান ছিল, ‘দম রাখো, হাওয়া ঘুরবে’! রাজ্যে যখন ‘হাওয়া ঘোরা’র কিছু ইঙ্গিত ধরা পড়ছে, কর্মী-সমর্থকদের প্রতি আলিমুদ্দিনকে তখন আরও বেশি হুঁশিয়ারি দিতে হচ্ছে এখন আরও ‘দম রাখা’ রাখো! |