পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণার আগেই টানাপোড়েন বেড়েই চলেছে শাসক জোটে।
রাজ্যের মন্ত্রিসভা থেকে সরে কংগ্রেসের সরে দাঁড়ানোর উচিত বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ওমপ্রকাশ গুপ্ত। মালদহের জেলা কংগ্রেস সভাপতি আবু হাসেম খান চৌধুরীও (ডালু) তাঁর কথার প্রতিধ্বনি করেই জানিয়েছেন, ওই জেলায় পঞ্চায়েত ভোটে কংগ্রেস একা লড়বে।
পক্ষান্তরে, পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলায় একক ভাবে লড়াইয়ের জন্য দলীয় কর্মীদের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাওড়া জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা রাজ্যের কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায়ও। রবিবার তিনি আমতার গাজিপুরে উলুবেড়িয়া উত্তর বিধানসভা কেন্দ্র তৃণমূলের পঞ্চায়েতরাজ সম্মেলনের উদ্বোধন করে এই নির্দেশ দেন।
শাসক শিবিরের একাংশের ব্যাখ্যা, পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণার আগেই তৃণমূল এবং কংগ্রেস, দু’দলই প্রকৃতপক্ষে পরস্পরের উপরে ‘চাপ’ সৃষ্টি করতে চাইছে। কারণ, ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের মধ্যে জেলা পরিষদে অন্তত আসন ভাগাভাগি নিয়ে দুই জোট শরিকের মধ্যে টানাপোড়েন নতুন কোনও ঘটনা নয়। একেবারে নিচু তলায় পঞ্চায়েতে জোট হওয়া বা না-হওয়ার বিষয়টি অবশ্য স্থানীয় সমীকরণের উপরেই নির্ভর করে বেশি। পাশাপাশি, তৃণমূল শিবিরের একাংশের বক্তব্য, জোট সরকার ছেড়ে কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে গেলে তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই আখেরে ‘লাভ’। সরকার চালানোর জন্য এমনিতেই তৃণমূল কংগ্রেসের উপরে নির্ভরশীল নয়। সরকার থেকে কংগ্রেস সরে দাঁড়ালে তাদের হাতে-থাকা সাত জন মন্ত্রীর ‘বিকল্প’ তখন তৃণমূল থেকেই বেছে নিতে পারবেন মুখ্যমন্ত্রী।
পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ড থেকে কেতুগ্রাম, বর্ধমানের খুন থেকে ধানের দাম না-পেয়ে কৃষকের আত্মহত্যা এই সব ঘটনার জেরে এই মমতার নেতৃত্বাধীন সরকারের ‘ভাবমূর্তি’ দ্রুত খারাপ হচ্ছে বলে মনে করছেন কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশ। এই সূত্রেই ওমপ্রকাশ এ দিন উত্তরবঙ্গে বলেছেন, “কংগ্রেসের মন্ত্রীদের কোনও কাজ নেই। তাঁরা স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারছেন না। বিভিন্ন জায়গা থেকে দলের কর্মীরা মন্ত্রিসভায় থেকে লাভ কী, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। রাজ্যের যা পরিস্থিতি, তাতে বিষয়টা সত্যিই উদ্বেগের।” একই সঙ্গে তিনি অবশ্য বলেন, “জোট করে ক্ষমতায় এসেছি। এখনই জোট থেকে বেরিয়ে গেলে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাবে। তবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বুঝতে পারছেন, যে জনপ্রিয়তা নিয়ে সরকার এসেছিল, এখন আর তা নেই।”
দুষ্কৃতীদের হাতে নিহত যুব কংগ্রেস নেতা পুলক তরফদার ওরফে রিন্টুর পরিবারকে সমবেদনা জানাতে ওমপ্রকাশ এবং প্রদেশ কংগ্রেসের আর এক সাধারণ সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তী এ দিন দক্ষিণ দিনাজপুরে যান। মন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন, মালদহের সাংসদ তথা জেলা কংগ্রেস সভাপতি ডালুবাবু এবং বিধায়ক সমর মুখোপাধ্যায়ও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। মালদহে সার্কিট হাউজে সাংবাদিক বৈঠকে জেলা কংগ্রেস সভাপতিও রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে কংগ্রেসের সরে আসার পক্ষে সওয়াল করেন। ডালুবাবুর কথায়, “কংগ্রেস বিধায়কদের এই মন্ত্রিসভায় থাকা উচিত নয়। মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে এসে পঞ্চায়েতে একক ভাবে লড়াই করলে কংগ্রেস ভাল ফল করবে। পঞ্চায়েত ভোটে মালদহে কংগ্রেস একক ভাবে লড়াই করবে।” রাজ্যের শ্রম প্রতিমন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন অবশ্য তাঁর আগের অবস্থানের কথাই ফের ব্যক্ত করেছেন। সাবিনার বক্তব্য, “হাইকম্যান্ড যে দিন নির্দেশ দেবে, সে দিনই মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসব!” অমিতাভবাবুর আক্ষেপ, “পরিবর্তন হয়ে লাভ কী হল!”
অন্য দিকে, তৃণমূলের অরূপবাবুর নির্দেশ, উলুবেড়িয়া উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের অধীন ১৪টি পঞ্চায়েতের প্রতিটি সংসদে প্রার্থী নির্বাচনের কাজ সেরে ফেলতে হবে। দলের সম্মেলনে তিনি বলেছেন, “পঞ্চায়েত নির্বাচন হওয়ার কথা আগামী বছরের মে মাস নাগাদ। তার আগেও যে কোনও দিন নির্বাচনের দিন ঘোষণা হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে একক ভাবে লড়াই করতে যাতে আমাদের কোনও অসুবিধা না-হয়, তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির প্রতিটি আসনে প্রার্থী নির্বাচনের কাজ সেরে রাখতে হবে।”
গত নভেম্বরে উলুবেড়িয়ায় কংগ্রেসও ‘পঞ্চায়েতরাজ সম্মেলন’ করে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের উপস্থিতিতে তাঁদের কর্মীরাও পঞ্চায়েত ভোটে একা লড়াই করার দাবি তুলেছিলেন। সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অরূপবাবু বলেছেন, “কয়েক মাস আগে এই জেলাতেই কংগ্রেস কর্মীরা একক ভাবে লড়াই করবেন বলে হুমকি দেন। তা ছাড়া, কংগ্রেস সিপিএমের সুরে কথা বলছে, এটাও স্পষ্ট। সেই কারণে আমরাও একক ভাবে লড়াই করতে প্রস্তুত!” বাগনানেও এ দিন সম্মেলনের উদ্বোধন করে একই সুরে কথা বলেন অরূপবাবু।
তবে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট অটুট থাকলে সেই অনুযায়ী যে ‘কাজ’ হবে, সে কথাও বলেন অরূপবাবু। তাঁর বক্তব্য, “আমরা একক ভাবে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি সেরে রাখতে চাই। তবে কংগ্রেসের সঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনে জোট বেঁধে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত হলে দলীয় নির্দেশ মেনে কাজ করা হবে।” গোষ্ঠী-কোন্দলের ফলে দলের ‘ভাবমূর্তি’র যে ক্ষতি হচ্ছে, সেই বিষয়েও দলীয় কর্মীদের সতর্ক করেন জেলা তৃণমূল সভাপতি। |