অবশেষে উত্তর কোরিয়া পরমাণু বোমা তৈয়ারির পথ হইতে সরিয়া আসিতে সম্মত। চিনের মধ্যস্থতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহিত এই মর্মে যে চুক্তি সম্পাদিত হইয়াছে, তাহাতে অতঃপর আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি কমিশনের পর্যবেক্ষকদের কোরীয় চুল্লিগুলি পরিদর্শনে আর কোনও বাধা থাকিবে না। ইহা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উত্তেজনা প্রশমনের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ইহার সহিত উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ ক্ষমতায় অভিষিক্ত কিম জং-আন-এর সদিচ্ছার প্রত্যক্ষ সংযোগ রহিয়াছে। তাঁহার পিতা প্রয়াত কিম জং-ইল-এর সময় হইতেই পরমাণু কর্মসূচি স্থগিত রাখার উদ্যোগটি শুরু হইয়াছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাহা স্থগিত হইয়া যায় এবং পিয়ংইয়ং পুনরায় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতি রণোন্মত্ততা দেখাইতে শুরু করে। চিনের মধ্যস্থতায় নবীন কোরীয় নেতৃত্বকে যে পরমাণু প্রসার রোধের কর্মসূচিতে শামিল করা গেল, ইহা সারা বিশ্বের পক্ষেই একটি বিশেষ সুসমাচার।
পরমাণু কর্মসূচির কারণেই উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক অবরোধ চালু হয়। ওই অবরোধ সে দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করিয়া দেয়। খাদ্যসামগ্রীর অভাব দেশে দুর্ভিক্ষকালীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এবং জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থাও ভাঙিয়া পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই উভয় ক্ষেত্রেই সহযোগিতায় সম্মত হইয়াছে। পিয়ংইয়ংকে আড়াই লক্ষ টন খাদ্য অচিরে সরবরাহ করিয়া সেখানকার খাদ্যসঙ্কট মোচনের আশ্বাস দিয়াছে ওয়াশিংটন। সেই সঙ্গে সে দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মিটাইতে হাল্কা জলের পরমাণু চুল্লিও কোরিয়াকে দেওয়া হইবে। এই সব চুল্লি হইতে পরমাণু মারণাস্ত্র বানানো যাইবে না, তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অসুবিধা নাই। মার্কিন প্রশাসনের তরফে পিয়ংইয়ংয়ের বিরুদ্ধে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রকেও সাহায্যের ডালি লইয়া আগাইয়া আসিতে প্রাণিত করিবে। উত্তর কোরিয়া আর পশ্চিমী গণতন্ত্রের কাছে অচ্ছুত থাকিবে না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাহার একঘরে দশাও ঘুচিয়া যাওয়ার সম্ভাবনা। উত্তর কোরিয়ার দৃষ্টান্তটি দেখাইয়া দেয়, হুমকি ও ভীতিপ্রদর্শনের দ্বারা যাহা অর্জন করা যায় না, সহানুভূতি ও সংবেদনশীলতা লইয়া অগ্রসর হইলে তথাকথিত শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রকেও স্তিমিত করা যায়। আর এই সূত্রেই ইরানের প্রসঙ্গটি আলোচিত হইবার দাবি রাখে।
উত্তর কোরিয়ার মতো ইরানকেও একদা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াকার বুশ ‘শয়তানি অক্ষ’-এর অন্তর্ভুক্ত করিয়াছিলেন। ইরান পরমাণু বোমা বানাইতে বদ্ধপরিকর, এই পূর্বানুমানের ভিত্তিতে তাহার বিরুদ্ধেও বাণিজ্যিক অবরোধ চালু হয়। এমনকী ইরান হইতে তেল কিনিলেও ক্রয়কারী দেশকে রক্তচক্ষু দেখানো হইতেছে। অথচ উত্তর কোরিয়ার মতো ইরানের সঙ্গেও মৈত্রী ও সংবেদনশীলতা লইয়া আলোচনা চালাইলে সুফল ফলিবার সম্ভাবনা। আয়াতোল্লা খোমেইনির ইসলামি বিপ্লবের কাল হইতে ইরানের প্রতি মার্কিন প্রশাসন যে বিরূপতা ও বিদ্বেষ লালন করিয়া আসিতেছে, তাহার বৃত্ত হইতে বাহির হওয়া দরকার। ইরানকে তাহার একমাত্র রফতানিযোগ্য পণ্য তেল বিক্রয়ের অধিকারও অনুমোদন করিতে হইবে। বিপরীতে হরমুজ প্রণালী অবরুদ্ধ করিয়া তাহাকে ভাতে-পানিতে মারার অমানবিক পদ্ধতিও রদ হউক, প্রত্যাহৃত হউক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। এই পথেই ইরানও উত্তর কোরিয়ার মতো নিরস্ত্রীকরণে সম্মত হইতে পারে। অন্তত তাহার একটি সম্ভাবনা রহিয়াছে। |