ভারতীয় অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভাল নাই, এই কথাটি বর্তমান অর্থবর্ষে বারে বারেই টের পাওয়া গিয়াছে। গত বৎসর বাজেট পেশ করিবার সময় অর্থমন্ত্রী দেশের আর্থিক বৃদ্ধি সম্বন্ধে যে আশার কথা জানাইয়াছিলেন, তাহা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হইতে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার, সকল প্রতিষ্ঠানই বৃদ্ধির হারের পূর্বাভাস দফায় দফায় কমাইয়াছে। সব যখন জানাই ছিল, তখন তৃতীয় ত্রৈমাসিকে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জি ডি পি) বৃদ্ধির হার মাত্র ৬.১ শতাংশ হইয়াছে দেখিয়া হতাশ হইবার কারণ কি? কারণ অনেকগুলি আছে বটে। প্রথম কারণটি মনস্তাত্ত্বিক। যতই প্রত্যাশিত হউক, যতই জানা থাকুক, দুঃসংবাদমাত্রেরই একটি নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব থাকে। আশঙ্কা করা, এবং সেই আশঙ্কা সত্যে পরিণত হওয়ার মধ্যে যে ফারাক আছে, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। এই মনস্তাত্ত্বিক চাপের উপর একটি সমাপতনের ভার যুক্ত হইয়াছে। তিন বৎসর পূর্বে একটি ত্রৈমাসিকে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার এই ৬.১ শতাংশই হইয়াছিল। সেই ত্রৈমাসিকটি আর্থিক সংকটের স্মৃতি বহন করিতেছে। দ্বিতীয় কথা, তৃতীয় ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হারটি একটু বেশিই নিচু হইয়াছে। সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিকাল অর্গানাইজেশন কিছু দিন আগে জানাইয়াছিল, বর্তমান অর্থবর্ষে জি ডি পি ৬.৯ শতাংশ বাড়িবে। তাহা যথেষ্টই কম। কিন্তু, তৃতীয় ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার যে পরিমাণ কমিয়াছে, তাহাতে এই ৬.৯ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা ছুঁইতেও চতুর্থ ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ হওয়া প্রয়োজন। গোটা বছর ধরিয়া ভারতীয় অর্থনীতি যে পথে হাঁটিয়াছে, তাহাতে চতুর্থ ত্রৈমাসিকে এই বৃদ্ধির হার কার্যত অসম্ভব। ফলে, আর আগামী সপ্তাহের শেষে অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন বাজেট পেশ করিবেন, তখন আরও এক দফা প্রত্যাশিত দুঃসংবাদের জন্য প্রস্তুত থাকাই ভাল।
কোনও একটি বা দুইটি ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার কমিয়া যাওয়া দুশ্চিন্তার বিষয় বটে। ভারতের ক্ষেত্রে যে কারণগুলিতে এই হার কমিতেছে, তাহা আরও বেশি দুশ্চিন্তার। এই ত্রৈমাসিকে নির্মাণশিল্পে বৃদ্ধির হার এক শতাংশেরও কম। গোটা অর্থবর্ষ জুড়িয়াই নির্মাণশিল্পের বৃদ্ধির হার হ্রাস পাইয়াছে। প্রথম দুইটি ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৭.২ শতাংশ এবং ২.৭ শতাংশ। সমগ্র ছবিটি দেখিলে আশঙ্কা হয়, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কঠোর আর্থিক নীতি বিনিয়োগের পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছে। ক্যাপিটাল ফর্মেশন বা মূলধন গঠনের হারও ক্রমে শ্লথ হইতেছে। খনি ক্ষেত্রে আয় এই ত্রৈমাসিকেও হ্রাস পাইয়াছে। অতি আশঙ্কার বিষয়, তৃতীয় ত্রৈমাসিকে পরিষেবা ক্ষেত্রের বৃদ্ধির গতিও কিঞ্চিৎ ধাক্কা খাইয়াছে। শিল্পক্ষেত্রের গতিভঙ্গকে এত দিন পরিষেবা ক্ষেত্রের ঔজ্জ্বল্যে ঢাকিয়া রাখা গিয়াছিল। সেই আবরণটিও যদি খসিয়া যায়, মুশকিল বইকী। অর্থমন্ত্রীর মুশকিল অবশ্য ইহাতেই ফুরাইতেছে না। একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সি রঙ্গরাজন জানাইয়াছেন, ভারতের রাজকোষে প্রাথমিক ঘাটতির যে অবস্থা দাঁড়াইয়াছে, ১৯৯১ সালের সংকটের মুহূর্তেও ছবিটি এত খারাপ ছিল না। রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ তাহার লক্ষ্যসীমাকে ছাপাইয়া বহু দূর চলিয়া গিয়াছে। রাজস্ব ঘাটতির ক্ষেত্রেও ছবিটি অন্য রকম নহে। মুশকিল হইল, অর্থমন্ত্রীর না আছে আয় বাড়াইবার উপায়, না আছে ব্যয় কমাইবার উপায়। উভয় ক্ষেত্রেই রাজনীতি আসিয়া অর্থনীতির হাত বাঁধিয়া দিবে বলিয়া অনুমান করা চলে। বিলগ্নিকরণের সাম্প্রতিক ব্যর্থ প্রচেষ্টাও একটি অশনি সংকেত বহন করিতেছে গত বাজেটে যাহা অর্থমন্ত্রীর রক্ষাকবচ হইয়াছিল, এই বাজেটে তাহা উধাও। এই বাজেট অর্থমন্ত্রীর কঠিন পরীক্ষা। |