এরোট্রোপলিস
মমতায় এখনও ‘ভরসা’ রাখছে সিঙ্গাপুর সরকার
সুতোয় ঝুলছে ইনফোসিস-ভাগ্য। রাজ্য সরকারকে দেওয়া জমির অগ্রিম অর্থ ফেরত চাইছে ভূষণ স্টিল। জমি-নীতি নিয়ে ‘আশাবাদী’ নয় শিল্পমহল। এই আবহেও দুর্গাপুর বিমানবন্দর প্রকল্পের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের উপর ‘ভরসা’ রাখছে সিঙ্গাপুর সরকার। তাদের বক্তব্য, “সামগ্রিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশের একটা বদল হয়েছে। আমরা অপেক্ষা করতে রাজি।”
ক’দিন আগে যিনি বন্ধ রুখতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ঝাঁপিয়েছিলেন, তাঁর কাছে এই ভরসা ‘স্বস্তিজনক’। শিল্পমহল যখন ক্রমাগত নেতিবাচক সঙ্কেত (জার্মানির মোটর নির্মাণকারী সংস্থা ফোক্সভাগেন ছাড়া) পাঠাচ্ছে, তখন মমতা-সরকারের ‘পাশে’ সিঙ্গাপুর সরকার ‘পরিবর্তনে’র জমানায় এমন শংসাপত্র পেয়ে আশ্বস্ত রাজ্য শিল্প দফতরও।
দুর্গাপুরের বিমানবন্দর প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত সিঙ্গাপুরের ‘চাঙ্গি’ বিমানবন্দর সংস্থা। সেই কারণেই বিষয়টি নিয়ে ‘উৎসাহী’ সিঙ্গাপুর সরকার। এবং তাদের দাবি, যদিও প্রকল্প আগেই শেষ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, তবুও চাঙ্গির প্রতিনিধিরা অপেক্ষা করতে রাজি। সিঙ্গাপুর সরকারের ‘ইন্টারন্যাশনাল এন্টারপ্রাইজ’ দফতরের (যে দফতর বিদেশে সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের বিষয়টি দেখভাল করে) ডেপুটি ডিরেক্টর রায়ান অ্যাং আনন্দবাজারকে বলেছেন, “চাঙ্গি কর্তৃপক্ষ মনে করছেন না, হাল ছেড়ে দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
নিজস্ব চিত্র
এখানে তো কোনও ইনস্ট্যান্ট কফি তৈরি হচ্ছে না! যে মেশিনের বোতাম টিপলাম আর হয়ে গেল!”
তবে ‘সমস্যা’ যে এখনও রয়ে গিয়েছে, রায়ান তা স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁর কথায়, “জমির মালিকদের (স্টেক-হোল্ডার) কিছু সমস্যা আছে। সেটা মিটিয়ে ফেলার জন্য চাঙ্গি কর্তৃপক্ষ রাজ্য সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। তারা এখনও আশাবাদী।” পাশাপাশিই তাঁর বক্তব্য, “আগে একটা নেতিবাচক মনোভাব ছিল ঠিকই। কিন্তু এখন সেটা নেই বলেই মনে হয়।”
বস্তুত, এই মুহূর্তে বিষয়টিতে ‘হস্তক্ষেপ’ করতে চাইছে না সিঙ্গাপুর সরকারও। সম্প্রতি ভারতীয় সাংবাদিকদের এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনার সময় সিঙ্গাপুরের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী লিম কিয়াং বলেছেন, “ওই প্রকল্পে কোনও জটিলতা নিয়ে চাঙ্গি কর্তৃপক্ষ এখনও আমাদের কাছে কোনও হস্তক্ষেপ চায়নি। তেমন কিছু করলে তখনই আমরা বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারের সঙ্গে কথা বলি। নইলে ব্যাপারটা ওই শিল্প সংস্থার উপরেই নির্ভর করে। আমার মনে হয়, তেমন কোনও পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি। ফলে সরকারের তরফে আমরা নাক গলাচ্ছি না।”
ভারতে যে মাত্র দু’টি প্রকল্পের উপর সিঙ্গাপুর সরকার অত্যন্ত ‘গুরুত্ব’ দিচ্ছে, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুর-অন্ডালের ‘এরোট্রোপলিস’ অন্যতম। অন্যটি হল দিল্লি-মুম্বই ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডর। পশ্চিমবঙ্গের প্রকল্পটি যৌথ উদ্যোগে করছে ‘বেঙ্গল এরোট্রোপলিস প্রোজেক্টস লিমিটেড’ (বিএপিএল) এবং সিঙ্গাপুরের ‘চাঙ্গি এয়ারপোর্ট অথরিটি’ (সিএআই)। প্রকল্পটিতে চাঙ্গি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের ২৬ শতাংশ অংশীদারি রয়েছে। সিঙ্গাপুর সরকারের সরবরাহ-করা নথিতে দেখা যাচ্ছে, প্রকল্পের পুরো এলাকা ২ হাজার ১৭০ একর। যার মধ্যে সাড়ে ৬৫০ একরে বিমানবন্দর। বাকি জমি ব্যবহৃত হবে আবাসন, তথ্যপ্রযুক্তি, অন্যান্য শিল্প, বিনোদন এবং সেই সংক্রান্ত সুযোগসুবিধার জন্য।
রাজ্য শিল্প দফতর সূত্রের তথ্য বলছে, বাম সরকারের আমলে যখন প্রকল্প শুরু হয়, তখন জমির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩৪৬ একর। কিন্তু ক্ষতিপূরণ নিয়ে ‘জটিলতা’র ফলে ১৪৪ একর জমি প্রকল্প থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। তারপরেও ১৯২ একর জমি ছাড়ার একটা কথা চলছিল। কিন্তু যে এলাকায় ওই জমি ছাড়া নিয়ে আলোচনা চলছে, সেখানে ২ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে প্রস্তাবিত বিমানবন্দর পর্যন্ত একটি রাস্তা তৈরি হওয়ার কথা। পরিভাষায় যাকে বলা হচ্ছে, ‘এমএআর’ (মেন আর্টারি রোড)। তা ছাড়া ওই জমিতে একটি ‘থিম পার্ক’ তৈরিরও পরিকল্পনা রয়েছে।
ফলে ওই জমি ছাড়ার সমস্যা রয়েছে। ‘জটিলতা’ রয়ে গিয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ১৬৪ একর জমি নিয়েও। ওই জমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রক ছাড়তে চাইছে না। নিয়ম অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের সঙ্গে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ওই পরিমাণ জমি ‘বিনিময়’ হওয়ার কথা। সে কারণে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এ কে অ্যান্টনির ‘হস্তক্ষেপ’ জরুরি। গত নভেম্বরে জমিটি নিয়ে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল চাঙ্গি এবং বিএপিএল কর্তাদের।
ঠিক ছিল, তারপর শিল্পমন্ত্রীর ‘মধ্যস্থতা’য় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে চাঙ্গি কর্তৃপক্ষের একটি বৈঠক হবে। পর্যায়ক্রমে যাওয়া হবে অ্যান্টনির কাছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকটিই এখনও হয়ে উঠতে পারেনি। পার্থবাবুর অবশ্য দাবি, “ওই প্রকল্প নিয়ে কোনও জটিলতা নেই। কাজ এগোচ্ছে। যদিও যে ভাবে জমি নেওয়া হয়েছিল, সেটা আমরা নীতিগত ভাবে সমর্থন করি না। কিন্তু ওরা আমাদের পরামর্শ মতো চুক্তিতে পরিবর্ধন এবং পরিমার্জন করেছে। আমার মনে হয়, সময় মতোই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।”
বিএপিএলের তরফে পার্থ ঘোষ জানাচ্ছেন, বিমানবন্দর চালু হওয়ার কথা চলতি বছরের অক্টোবরে। জুলাই মাস নাগাদ নির্মাণকাজ শেষ হয়ে যাবে। পার্থবাবুর কথায়, “প্রাথমিক ভাবে রোজ দু’টি নয়াদিল্লির উড়ান, একটি মুম্বইয়ের উড়ান এবং সপ্তাহে চারদিন হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু এবং চেন্নাইয়ের উড়ান ছাড়বে ওই বিমানবন্দর থেকে।” যা বাস্তবায়িত হলে দক্ষিণবঙ্গের ছবিটাও আমূল বদলে যাবে।
তবে রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থবাবু যে ‘পরিবর্ধন এবং পরিমার্জনে’র কথা জানিয়েছেন, তা নিয়েও খানিক ‘জটিলতা’ রয়েছে বলে সিঙ্গাপুর সূত্রের খবর। রাজ্য শিল্প দফতরের এক পদস্থ অফিসারের কথায়, “জয়েন্ট ভেঞ্চার ডেভেলপমেন্ট এগ্রিমেন্টে মোট ২৮টা রদবদলের পর ২৯তম খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। এরপরেও আবার রদবদল করতে গেলে চাঙ্গির তরফে পুরো প্রকল্পটাই বাতিল করে দেওয়ার একটা সম্ভাবনা রয়ে যাচ্ছে। যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে ওদের তরফে আমাদের কিছু জানানো হয়নি। কিন্তু শেষপর্যন্ত তেমন হলে মুখ পুড়বে রাজ্যেরই।”
সম্প্রতি রাজ্যে বন্ধ মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা যথেষ্ট ‘কড়া’ মনোভাব নিয়েছেন। যার ফলে শিল্প-বাণিজ্য মহলের ‘সন্তুষ্ট’ থাকারই কথা। সেই সূত্রেই শিল্পমহলের ‘আশা’, দুর্গাপুরের বিমানবন্দর নিয়েও ‘সচেষ্ট’ হবেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘটনাচক্রে, প্রকল্পটি হয়েছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রফুল্ল পটেল এবং সিঙ্গাপুরের তৎতালীন শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রী রেমন্ড লিনের আলোচনার সাপেক্ষে সরকারের সঙ্গে সরকারের (জি-টু-জি) ভিত্তিতে। ফলে সিঙ্গাপুরের কাছেও প্রকল্পটি যথেষ্ট ‘প্রেস্টিজিয়াস’। সেই কারণেই রাজ্য সরকারও প্রকল্পটি নিয়ে ‘যথাসাধ্য’ করবে বলেই তাদের বিশ্বাস।
প্রসঙ্গত, এই প্রকল্পটি রাজ্যে এখনও পর্যন্ত বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগ। জমির দাম এবং বিমানবন্দর নির্মাণ মিলিয়ে যার ব্যয় প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। পাশাপাশি, রাজ্যে আপাতত এটিই একমাত্র পরিকাঠামোগত প্রকল্প (কোর ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল প্রজেক্ট)।
শিল্পমন্ত্রী পার্থবাবুর বক্তব্য, রাজ্য সরকারের তরফে নয়াদিল্লিতে সিঙ্গাপুর হাই কমিশনের সঙ্গে তাঁদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। প্রকল্প ঠিকমতোই এগোচ্ছে। আর সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের আশা, রাজ্য সরকারের মনোভাব যেহেতু সামগ্রিক ভাবে ভারত সরকারেরই মনোভাব ব্যক্ত করবে, তাই রাজ্যে এবং কেন্দ্র উভয়পক্ষই সমস্যা সমাধানে দ্রুত উদ্যোগী হবে।
নচেৎ ‘ন্যানো-ইতিহাসে’র পুনরাবৃত্তি দেখবে রাজ্য।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.