সিটু-আইএনটিইউসি-সহ ১১টি ট্রেড ইউনিয়নের ডাকা দেশ জোড়া শিল্প ধর্মঘটের প্রাক্কালেই সিপিএম-তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল উত্তরবঙ্গে। সোমবার সন্ধ্যায় ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জে ঘটনাটি ঘটেছে। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন জখম হন। মাথা ফেটে জখম হন তৃণমূলের ব্লক সভাপতি লক্ষ্মীকান্ত সরকার। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি আয়ত্বে আনলেও এলাকায় উত্তেজনা রয়েছে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব অবশ্য বলেছেন, “জনজীবন স্তব্ধ করার চেষ্টা মানুষ বরদাস্ত করবেন না। গোলমাল পাকাতে প্ররোচনা তৈরির চেষ্টা হতে পারে। মানুষ তা রুখবেন।” এদিন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিদের বৈঠক করে দোকানপাট খোলা রাখার ব্যাপারে সবরকম সাহায্য করার আশ্বাস দেন। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, ধর্মঘট নিয়ে পাহাড় ও তরাই-ডুয়ার্সেও গোলমালের আশঙ্কায় প্রতিটি এলাকায় বাড়তি পুলিশ বাহিনী পাঠানো হয়েছে। দার্জিলিং পাহাড়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ধর্মঘটের বিরোধিতার ডাক দিয়েছে। |
মোর্চার প্রচার সচিব তথা বিধায়ক হরকাবাহাদুর ছেত্রী বলেন, “আমরা ধর্মঘটকে সমর্থন করছি না। চা বাগান, সিঙ্কোনা বাগান কাজ হবে। বাজারঘাট স্বাভাবিক রাখার কথা বলা হয়েছে। তবে কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে বন্ধকে সমর্থন করে, তাহলে সেটা তাঁর নিজস্ব বিষয়।” পক্ষান্তরে, তরাই ও ডুয়ার্সে আদিবাসী বিকাশ পরিষদ সাধারণ ধর্মঘটের বিরোধিতা করা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। তবে পরিষদ ধর্মঘটের পক্ষে রাস্তায় নামবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে। আদিবাসী বিকাশ পরিষদের রাজ্য সভাপতি বিরসা তিরকি বলেন, “আমরা ধর্মঘটের বিরোধিতা করছি না। তা বলে সমর্থনে রাস্তায় নামব না। ‘নিরপেক্ষ’ ভূমিকা পালন করব।” প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ধর্মঘটের দিন জাতীয় সড়ক, রেল স্টেশন ও বিমান বন্দর থেকে যাত্রীরা যাতে লাগোয়া শহরে স্বচ্ছ্বন্দ্যে যাতায়াত করতে পারেন সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। ব্যবস্থা করা হচ্ছে বাড়তি যানবাহনের। জনজীবন সফল রাখতে উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগম ১০০টি অতিরিক্ত বাস নামাবে বলে জানিয়েছেন সংস্থার চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। প্রয়োজন মতো যাতে বাস পাঠানো যায় সে জন্য উত্তরবঙ্গ জুড়ে পাঁচটি কনট্রোল রুম খোলার সিদ্ধান্তও নিয়েছে নিগম। শিলিগুড়ি মহকুমা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিউ জলপাইগুড়ি এবং বাগডোগরা বিমান বন্দরে যাতায়াতের জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা রাখা হবে বলে জানিয়েছেন শিলিগুড়ির মহকুমাশাসক বৈভব শ্রীবাস্তব। জাতীয় সড়কে অবরোধের চেষ্টা করা হলে গ্রেফতার করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। ধর্মঘট সফল করার ডাক দিয়ে যেমন, তেমনই তা ব্যর্থ করার আহ্বান জানিয়ে এদিন উত্তরবঙ্গ জুড়েই মিছিল, পাল্টা মিছিল হয়। দিনভর চলে বিবৃতি পাল্টা বিবৃতির লড়াই। ধর্মঘটের সমর্থনে শিলিগুড়ি মহকুমা জুড়ে প্রচার চালায় দার্জিলিং জেলা বামফ্রন্ট। জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর-সহ উত্তরবঙ্গের অন্যত্রও মিছিল, পথসভা হয়। ধর্মঘটের দিন সকালে রাস্তায় নেমে ধর্মঘটের সমর্থনে মিছিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাম নেতাকর্মীরা। ফ্রন্টের দার্জিলিং জেলা আহ্বায়ক তথা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য অশোক ভট্টাচার্য বলেন, “জোর করে ধর্মঘট করানোর ব্যাপার নেই। গণতান্ত্রিক ভাবে প্রচার চালানো হবে। আমাদের বিশ্বাস, সাধারণ মানুষ ধর্মঘটে সামিল হবেন।” |
বামেদের অভিযোগ, তৃণমূল প্ররোচনা দিচ্ছে। রাজ্যের প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অভিযোগ করেন, “স্থানীয় মন্ত্রী বন্ধ ব্যর্থ করতে রাস্তায় নামবেন বলে প্ররোচনা তৈরি করছেন। অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। পুলিশ কর্তাদের সে কথা জানানো হয়েছে। আমরা কর্মীদের কোনও প্ররোচনায় পা না-দিতে বলেছি।” এদিন জীবেশবাবু অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্ররোচনা তৈরির অভিযোগ করেছেন। অন্যদিকে, প্ররোচনা সৃষ্টির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী। তিনি বলেন, “পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমি নিজে রাস্তায় থাকব। কোনও রকম বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করা হবে না।” তিনি জানান, শিলিগুড়িতে তিনটি কনট্রোল রুম খুলে ধর্মঘটের মোকাবিলা করা হবে। এদিন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরে ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক করেন গৌতমবাবু। বামেদের ডাকা ধর্মঘটকে ঘিরে উত্তেজনার পারদ চড়ছে কোচবিহারেও। সন্ধ্যায় মেখলিগঞ্জে সংঘর্ষের পরে ফরওয়ার্ড নেতা উদয়ন গুহ অভিযোগ করেন, তৃণমূল সমর্থকেরাই তাঁদের প্রথমে হামলা চালায়। পাল্টা অভিযোগ করেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। ধর্মঘট সফল করতে এ দিন ডুয়ার্স-সহ জলপাইগুড়ি জেলা জুড়ে প্রচার হয়। সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সলিল আচার্য অভিযোগ করেন, “রাজ্য সরকার একের পর এক সার্কুলার জারি করে ভীতির পরিবেশ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে সাধারণ মানুষের কাছে তা মোটেও সাড়া ফেলেনি।” বনধের বিরোধিতা করে কর্মীরা মঙ্গলবার সকাল থেকেই রাস্তায় নামবে বলে জানিয়ে দিয়েছে জলপাইগুড়ি জেলা যুব তৃণমুল সভাপতি সোমনাথ পাল। মালদহ ও দুই দিনাজপুরেও এ দিন ধর্মঘটের সমর্থনে বামেরা প্রচার চালাম। পাল্টা প্রচার চালায় তৃণমূলও। মালদহের জেলাশাসক শ্রীমতি অর্চনা বলেন, “মুখ্যসচিবের নির্দেশ মতো জেলা ও ব্লকের সমস্ত অফিস খোলা রাখতে আধিকারিক ও কর্মীদের বলা হয়েছে।” উত্তর দিনাজপুরের সিপিএম জেলা সম্পাদকমণ্ডলী সদস্য অপূর্ব পাল জানান, শান্তিপূর্ণ ভাবেই রাস্তায় নেমে তাঁরা পিকেটিং করবেন। তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক অসীম ঘোষ বলেন, “সকাল থেকে জেলার সর্বত্র ধর্মঘটের বিরুদ্ধে কর্মীরা মিছিল করবেন। জোর করে ধর্মঘটের চেষ্টা হলে সাধারণ মানুষকে নিয়ে প্রতিবাদ করা হবে।” |