এক তৃণমূল কর্মীকে খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত তালড্যাংরার সিপিএম বিধায়ক মনোরঞ্জন পাত্র সোমবার খাতড়া আদালতে আত্মসমর্পণ করলেন। খাতড়ার এসিজেএম তাঁকে ১২ দিন জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। আগামী ৯ মার্চ ফের বিধায়ককে খাতড়া আদালতে হাজির করানো হবে। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার প্রণব কুমার বলেন, “তালড্যাংরার বিধায়ক মনোরঞ্জন পাত্রের আত্মসমর্পণের খবর আগাম জানা ছিল না। সব দিক বিবেচনা করে তদন্তের স্বার্থে হেফাজতে নেওয়ার বিষয়টি ভাবা হবে।”
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১০ সালের ২৯ জুন তালড্যাংরা থানার রাজপুর গ্রামে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষ বাধে। গুলিতে নিহত হন প্রৌঢ় তৃণমূল কর্মী মদন খাঁ। জখম হন তাঁর এক ছেলে। পর দিন নিহতের ছেলে ইসমাইল খাঁ তালড্যাংরা থানায় সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মনোরঞ্জন পাত্র, তাঁর ভাই জিতেন পাত্র-সহ ২২ জনের নামে খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। ওই অভিযোগে ইসমাইলের দাবি ছিল, ঘটনার দিন মনোরঞ্জনবাবুর নেতৃত্বে ‘সিপিএমের দুষ্কৃতীরা’ হামলা চালিয়েছিল। গত বছর ৩০ অগস্ট অন্যতম অভিযুক্ত, সিপিএমের তালড্যাংরা জোনাল কমিটির সদস্য জিতেন পাত্রকে বাঁকুড়া থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে। মোট ১৪ জন ধরা পড়েছেন ওই খুনের ঘটনায়। |
অভিযুক্ত আরও সাত জন সিপিএম কর্মী ইতিমধ্যেই হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পেয়েছেন। যদিও মাস তিনেক আগে মনোরঞ্জনবাবুর আগাম জামিনের আবেদন খারিজ করে দেয় হাইকোর্ট। সে ক্ষেত্রে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনও পথ খোলা ছিল না বলেই মনে করছে বাঁকুড়া জেলা পুলিশের একাংশ। এ দিন দুপুরে হঠাৎই খাতড়া আদালতে মনোরঞ্জনবাবু আত্মসমর্পণ করেছেন খবর ছড়ানোয় হইচই শুরু হয়ে যায়। মনোরঞ্জনবাবুর কথায়, “আইনের প্রতি আমার যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। তাই ভেবেচিন্তেই এ দিন আমি খাতড়া আদালতে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
এ দিন বিকেল সাড়ে ৩টে নাগাদ এসিজেএম ফটিকচন্দ্র মণ্ডলের এজলাসে হাজির হন এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতা মনোরঞ্জনবাবু। তাঁর আইনজীবী চঞ্চল রায় জামিনের আবেদন করে বলেন, “রাজনৈতিক কারণে আমার মক্কেলের নাম এই ঘটনায় জড়ানো হয়েছে। উনি ঘটনার দিন বিধানসভায় হাজির ছিলেন।” একই সঙ্গে মনোরঞ্জনবাবুকে রাজনৈতিক বন্দি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার আবেদন জানান চঞ্চলবাবু। সরকারি কৌঁসুলি নারদ ভুঁইয়া জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, “খুনের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্তের তালিকায় নাম রয়েছে মনোরঞ্জনবাবুর।” এসিজেএম জামিনের আবেদন নাকচ করে জেল হাজতে রাখার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি পুলিশকে কেস ডায়েরি জমা দেওয়ার নির্দেশও দেন। বিকেলে জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি শ্যামল সরকারের নেতৃত্বে দলের কর্মী-সমর্থকেরা আদালত চত্বরে বিক্ষোভ দেখান।
এ দিন আদালত চত্বরে মনোরঞ্জনবাবু অভিযোগ করেন, জেলা তৃণমূল সভাপতি শ্যাম মুখোপাধ্যায়ের ‘পরামর্শমতো’ এফআইআর লেখা হয়েছিল। তাঁর বক্তব্য, “সে জন্য এফআইরের প্রথমে আমারই নাম দেওয়া হয়। ওই দিন আমি বিধানসভায় ছিলাম। সেই হাজিরার শংসাপত্রও আদালতে জমা দিয়েছি।” বিধায়কের আরও অভিযোগ, “লোকসভা ভোটের পর থেকেই শ্যামবাবু ওই এলাকায় বোমা-গুলির রাজনীতি আমদানি করেছেন। উনি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করিয়েছিলেন।” বিধায়ক-পুত্র স্বরূপ পাত্রেরও দাবি, “এলাকার মানুষ জানেন, ওই ঘটনায় আমার বাবা কোনও ভাবেই জড়িত নন।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্র বলেন, “উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই ওই ঘটনায় মনোরঞ্জনবাবুর নাম জড়ানো হয়েছে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি এলাকায় যেতে পারছিলেন না। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পরে তিনি আমাদের পরামর্শ নিয়ে এ দিন আত্মসমর্পণ করেন। দল তাঁকে আইনি সহায়তা দেবে।”
রাজ্যের শিশুকল্যাণ মন্ত্রী তথা জেলা তৃণমূল সভাপতি শ্যামবাবু অবশ্য বিধায়ক বা সিপিএম নেতৃত্বের সমস্ত অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়ে দাবি করেছে, “এলাকা দখলে রাখার জন্যই গড়বেতা থেকে হার্মাদদের নিয়ে এসে ওই দিন রাজপুরে হামলা চালিয়েছিলেন মনোরঞ্জন পাত্র। আমরা বহুদিন ধরেই ওঁকে গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছি। আমি কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করিনি। আইন আইনের পথে চলুক।” |
মনোরঞ্জন পাত্র |
|
তালড্যাংরার ৪ বারের বিধায়ক
সিপিএমের বাঁকুড়া জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য |
২০১০ |
• ২৯ জুন সন্ধ্যায় তালড্যাংরার রাজপুরে খুন তৃণমূল কর্মী মদন খাঁ। জখম ছেলে, ভাইপো ও স্ত্রী।
• ৩০ জুন মনোরঞ্জনবাবু-সহ সিপিএমের ২২ জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ করেন মদনের ছেলে ইসমাইল খাঁ।
• তৃণমূলের ৯ জনের বিরুদ্ধে মারধরের পাল্টা অভিযোগ সিপিএমের।
• বাঁকুড়া জেলা আদালত দু’বার আগাম জামিনের আবেদন খারিজ।
• ২৪ অগস্ট জেলা আদালত ১৫ দিনের মধ্য তাঁকে খাতড়া আদালতে আত্মসমর্পন করার নির্দেশ দেয়।
• ফের বাঁকুড়া জেলা আদালতে জামিনের আবেদন। ৯ সেপ্টেম্বর নাকচ সেটাও।
• তদন্তকারী অফিসারের তদন্তে ভূমিকায় ক্ষোভ কোর্টের। উপযুক্ত কাউকে তদন্তভার দেওয়ার নির্দেশ। |
২০১১ |
• ১৯ মে বিধায়ককে গ্রেফতারের দাবিতে ডিএমকে স্মারকলিপি তৃণমূলের লিগ্যাল সেলের।
• বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর থেকে সপরিবারে তালড্যাংরা ছাড়া।
• ২২ ডিসেম্বর হাইকোর্টে আগাম জামিনের আবেদন খারিজ। |
২০১২ |
•২৭ ফেব্রুয়ারি দলের পরামর্শে জেলা পার্টি অফিস থেকে খাতড়া আদালতে আত্মসমর্পণ। |
|