তোলা না দেওয়ার ‘শাস্তি’, হাবরায় খুনের
চেষ্টা মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে
রিবার-পড়াশোনা চলে যে চায়ের দোকান চালিয়ে, তার রোজগার থেকে মদ খাওয়ার টাকা চেয়েছিল তোলাবাজেরা। দাবি না মানায় রবিবার রাতে ‘খুনের চেষ্টা’ হল উত্তর ২৪ পরগনার হাবরার এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে। মাথায় গুরুতর চোট, হাতে ছুরির আঘাত নিয়ে দীপঙ্কর মিস্ত্রি নামে ওই অনাথ ছাত্রটি এখন বারাসত হাসপাতালে ভর্তি। দিতে পারেনি পরীক্ষাও।
অভিযুক্তদের যে ক্লাব এবং ঠেকে দেখা যায়, সেখানে ভাঙচুর চালান ক্ষিপ্ত স্থানীয় বাসিন্দারা। নেতৃত্বে ছিলেন মহিলারা। কৃষ্ণপদ দাস নামে এলাকার এক তৃণমূল নেতার ‘ভূমিকা’ নিয়েও সরব হন এলাকাবাসীর একাংশ। তাঁদের অভিযোগ, তোলাবাজদের পক্ষ নিয়ে কৃষ্ণপদবাবু দীপঙ্করের বিরুদ্ধেই মারপিটের অভিযোগ জানাতে যান হাবরা থানায়। কৃষ্ণপদবাবু অবশ্য অভিযোগ মানেননি। ওই ভাঙচুরের পরেই দীপঙ্করের উপরে হামলায় জড়িত অভিযোগে কৃষ্ণ ঘোষ ও প্রদীপ মৃধা নামে দু’জনকে ধরে পুলিশ। পুলিশের দাবি, ধৃতেরা দু’জনেই তোলাবাজ। তাদের জেরা করা হচ্ছে বলে জানান পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্য।
জখম দীপঙ্কর মিস্ত্রি। বারাসত হাসপাতালে। নিজস্ব চিত্র
হাবরা স্টেশনের পাশে রেল কলোনিতে মামার বাড়িতে মানুষ দীপঙ্কর। তার দুই বোনও আছে। বছর ছয়েক আগে মা মারা যান। তখন দীপঙ্কর অষ্টম শ্রেণিতে। ওই বছরই বাড়ি ছেড়ে চলে যান বাবা। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় দীপঙ্করের। বছর পাঁচেক ধরে হাবরা স্টেশনের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে একটি ছোট্ট চায়ের দোকান চালাচ্ছিল বছর উনিশের ছেলেটি। সেই আয়েই চলত ছোট বোন দীপিকার পড়াশোনা এবং সংসারের যাবতীয় খরচ। বছর তিনেক আগে দীপঙ্কর নিজেও ভর্তি হয় হাবরা মডেল হাইস্কুলে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী দীপিকা বলে, “রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ দোকানে গিয়ে দাদাকে বলি, ‘আমি দোকান দেখছি। তোর পরীক্ষা। বাড়ি গিয়ে পড়তে বোস’। দাদাও রাজি হয়েছিল।” বছর তেরোর ওই কিশোরীর অভিযোগ, “তখনই প্ল্যাটফর্ম এলাকার ছ’টা ছেলে দোকানে এসে দাদার কাছে মদ খাওয়ার টাকা চায়। রাজি না হওয়ায় ওরা দাদাকে প্রচণ্ড মারে।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, বিধ্বস্ত অবস্থায় দীপঙ্কর বাড়ি ফিরতেই তার উপরে চড়াও হয় পিছু ধাওয়া করে যাওয়া ওই ছ’জন। তখন বাড়িতে দীপঙ্কর একা। তার আর এক বোন মুনমুনের অভিযোগ, “আমরা শুনেছি, দাদাকে বাড়ি থেকে চেনেহিঁচড়ে বার করে এলাকার একটা ক্লাব-ঘরে ঢুকিয়ে মারধর করে ওই ছেলেগুলো।” অভিযোগ, পাশেই একটি শৌচাগারের নোংরা জলের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় দীপঙ্করের। তার পরে পেটে ছুরি মারার চেষ্টা হয়। দীপঙ্কর আত্মরক্ষার জন্য সরে গেলে ছুরি লাগে তার বাঁ হাতে। এর পরে পিছন থেকে তার মাথায় বাঁশের বাড়ি মারা হয়। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দীপঙ্কর। তাকে মৃত ভেবে পালিয়ে যায় হামলাকারীরা।
দীপঙ্করের মামিমা পুতুল ব্যাপারি জানান, স্থানীয় বাসিন্দারাই দীপঙ্করকে উদ্ধার করে প্রথমে হাবরা স্টেট জেনারেলে নিয়ে যান। পরে তাকে সরানো হয় বারাসতে। পুতুলদেবী বলেন, “যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল, তখন দীপঙ্কর খালি বমি করছে। গা থেকে রক্ত ঝরছে।” বারাসত হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সুপার দেবীপ্রসাদ পারেখ বলেন, “ছাত্রটির মাথার সিটি স্ক্যান হয়েছে। শরীরেও অনেক চোট রয়েছে। তবে ওর অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল।”
হাবরায় তোলাবাজি, স্টেশন চত্বরে সাট্টা-চোলাইয়ের রমরমা আর তাকে কেন্দ্র করে খুন-জখম নতুন ঘটনা নয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, মাস ছয়েক ধরে দুষ্কৃতীদের দাপট ফের বেড়েছে। প্ল্যাটফর্মের পাশে সাট্টা, জুয়া, চোলাই-মাদকের আসরের সঙ্গে রমরমিয়ে চলছে তোলাবাজিও। প্ল্যাটফর্মে মহিলাদের উত্যক্ত করার ঘটনাও ঘটেছে। পুলিশকে জানালেও ‘লাভ হয় না’। যদিও পুলিশ ওই অভিযোগ মানেনি।
এই ঘটনায় তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র হাবরা শাখার নেতা কৃষ্ণপদবাবুর নাম জড়িয়ে যাওয়ায় ‘অস্বস্তি’তে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব। দীপঙ্করের মামা মৃণাল ব্যাপারির ক্ষোভ, “হাবরা থানা প্রথমে আমাদের অভিযোগ নিতে চায়নি। কৃষ্ণপদবাবু ওই দুষ্কৃতীদের নিয়ে হাবরা থানায় দীপঙ্করের নামেই মারধরের অভিযোগ করেন! পরে অবশ্য পুলিশ আমার অভিযোগ নেয়।’’ স্থানীয় কংগ্রেস নেতা বিশ্বজিৎ সমাদ্দারের দাবি, “কৃষ্ণপদবাবু থানায় গিয়ে উল্টে তোলাবাজদের হয়ে পুলিশকে চাপ দেন। আমরা তার প্রতিবাদ করি।” কৃষ্ণপদবাবু অবশ্য বলছেন, “ব্যাপারটা যাতে মিটে যায় সে জন্যই ওদের (দীপঙ্করের উপরে হামলায় অভিযুক্ত) সঙ্গে থানায় গিয়েছিলাম।” তাঁর সংযোজন, “ওই ছাত্রের উপরে আক্রমণের তীব্র নিন্দা করছি।” হাবরার তৃণমূল বিধায়ক ও খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “দলীয় ভাবে ওই ঘটনার তদন্ত চলছে। ছাত্রকে মারধরে অভিযুক্তদের সঙ্গে দলের কোনও নেতা জড়িয়ে ছিলেন বলে প্রমাণ মিললে, কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
দীপঙ্কর এ দিন পরীক্ষায় বসতে পারেনি জেনে হাবরা মডেল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অশোক চক্রবর্তী বলেন, “পড়াশোনায় দীপঙ্করের এতই আগ্রহ যে, আমরা ওকে বই-খাতা দিয়ে পড়ায় উৎসাহ দিতাম। সব চেয়ে দুঃখজনক, সামনের বার ও নিয়মিত ছাত্র হিসেবে পরীক্ষা দিতে পারবে না। মদ খাওয়ার জন্য তোলাবাজি করতে গিয়ে দুষ্কৃতীরা আমার ওই ছাত্রের ভবিষ্যতে একটা দাগ করে দিল!”
বারাসত হাসপাতালে দেখা গেল, দীপঙ্কর ব্যথায় কাতরাচ্ছে। তার মধ্যেই জড়ানো গলায় সে জানতে চায়, “পরীক্ষা কি শুরু হয়ে গিয়েছে?”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.