হুগলির দেবানন্দপুরের নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছ? আরে, যেখানে শরৎচন্দ্রর চট্টোধ্যায়ের জন্মস্থান। কৃষ্ণপুর তারই খুব কাছে। জি টি রোডের আদিসপ্তগ্রাম থেকে দেবান্দপুর মোড়ে গেলেই দেখবে, একটা লাল মাটির পথ বেঁকে গিয়েছে কৃষ্ণপুরের দিকে। হারিয়ে যাওয়া সরস্বতী নদী এক সময় এই অঞ্চল দিয়ে বইত। সেই নদী তীরের জায়গাটাকে লোকে কেষ্টপুর বলে ডাকে। এ বছরের ১ মাঘ সকালে, সেখানে যেতেই চক্ষু ছানাবড়া। বিশাল একটা চত্বর জুড়ে মাছের মেলা বসেছে। থরে থরে পনেরো-কুড়ি কিলোর রুই-কাতলা-মৃগেল-ভেটকি ডাঁই করা। অন্য দিকে ইয়াব্বড় ঝুড়ির ভেতর থেকে তরতরিয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে কাঁকড়ারা। দরাদরি, কেনাকেটিতে চারিদিক সরগরম। প্রমাণ সাইজের সব মৎস্যাবতার, ঘচাঘচ, ঝপাঝপ শব্দে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছেন। তার পর ভাল মানুষের মতো সিঁধিয়ে যাচ্ছেন বাজারের থলিতে। দশ-পনেরো-কুড়ি কিলোর পেল্লাই মাছ কিনেও ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। দৃশ্য বটে।
মেলাটা নাকি অন্তত পাঁচশো বছরের পুরনো। গ্রামের কাছেই ইতিহাস বিখ্যাত সপ্তগ্রাম বন্দর। সপ্তগ্রামের রাজা ছিলেন হিরণ্যদাস মজুমদার। তাঁর ভাই গোবর্ধন দাসের ছেলে রঘুনাথ, রাজামশাইয়ের আদরের ভাইপো, সকলের নয়নমণি। ধনদৌলতে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। ধমর্প্রাণ বালকটি মাত্র পনেরো বছর বয়েসে পায়ে হেঁটে পুরী চলে যান। সেখানে তাঁর দেখা হয় নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর সঙ্গে। মহপ্রভুর আদেশেই তিনি কৃষ্ণপুরে ফিরে আসেন। তাঁর ফিরে আসা উপলক্ষ্যেই ১ মাঘ উৎসব শুরু হয়েছিল।
তা, এই উৎসবে মাছেরা যোগ দিল কী করে? উত্তর দিলেন কৃষ্ণপুরের রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের সেবায়েত শৈলেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। ঘরে ফেরার পর, কৃষ্ণমগ্নপ্রাণ রঘুনাথের খ্যাতি আরও বাড়তে থাকল। তাঁর ভক্তির পরীক্ষা নিতে এলেন ৭০০ বৈষ্ণব। তাঁরা বললেন, ‘আমরা শুধু ইলিশ মাছের ঝোল আর আমের টক খাব।’ বিপদে পড়ে মনে মনে কৃষ্ণকে ডাকতে লাগলেন রঘুনাথ। ভক্তির জোরে জমিদারবাড়ির পুকুর থেকেই ধরা পড়ল জোড়া ইলিশ! আর দেখা গেল, মাঘের শীতেও মন্দির সংলগ্ন আম গাছে ঝুলছে এক ছড়া আম! বৈষ্ণবরা জবর ঠকলেন, রঘুনাথকে প্রণাম ঠুকে ফিরে গেলেন। মাছের মেলার শুরু সেই থেকে। |
এখনও মেলা উপলক্ষে এলাকা সংলগ্ন ব্যান্ডেল, চকবাজার, পান্ডুয়া, মগরা, চন্দননগর তো বটেই, এমন কী শিয়ালদা থেকেও কত লোক আসেন। অনেকেরই উদ্দেশ্য পিকনিক। এই মেলা থেকে মাছ কিনে তাঁরা ঢুকে পড়েন কৃষ্ণপুর দেবানন্দপুরের আমবাগান, কলাবাগানে। সেখানেই জমে ওঠে মৎস্যসহযোগে মহাভোজ। আর আসেন মৎস্যজীবী, মৎস্যবিক্রেতারা। কৃষ্ণপুর দেবানন্দপুরের বাড়ি বাড়ি এই সময় ভিড় জমান আত্মীয়রা। মাছ তো কেনেনই, নানা প্রজাতির বিশালাকৃতি মাছেদের স্বচক্ষে দেখার শখও কম নয়। সব মিলিয়ে প্রায় লক্ষ লোকের সমাগমে জমজমাট মছলিমেলা।
মেলায় সারা সকাল ঘুরে দেখি, দশ-পনেরো কিলোর ভেটকি, সামুদ্রিক শংকর মাছ অগুনতি। রুই-কাতলা-মৃগেলদের কথা তো আগেই বলেছি। ভেটকিই তো কত রকম, কত রঙের। ভোলা ভেটকি, কই ভেটকি, চাঁদা ভেটকি., লাল, কালো, রুপোলি সাদা। সঙ্গে রয়েছে নানা রকম গুড়জালি মাছ, আড় মাছ, ট্যাংরা, হালুয়া, কয়েক ফুট লম্বা পাঙ্গাস, গানদাস, রূপচাঁদা ,পায়রা চাঁদারা। কী বিশাল বিশাল দাঁড়ার চিংড়ি! হারিয়ে যেতে বসা কয়েকটা মৎস্যপরিবারও হাজির। যেমন চ্যাং, শাল, শোল, বোয়াল, ল্যাটা মাছ। এক সময়ে এখানে দেখা যেত বাঙ্গোস, কাকলেশ, বান, গুঁতে, পাঁকালের মতো বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির কিছু মাছ। সামুদ্রিক দুর্লভ মাছেদের নিয়ে প্রদর্শনীও হত। কিন্তু সে সব দিন গিয়েছে।
স্থলবাসীরা তো ইদানীং জলজ প্রাণীদের নিয়ে ভারী ভাবনা-চিন্তা করেন। খুব সাধারণ মাছের বাজারেও ক্যামেরা হাতে গুঁতোগুঁতি করেন। বাজারের বিক্রেতা, জেলে, এমনকী শখের মেছুড়েদেরও ধাওয়া করেন। কত প্রশ্ন, এগুলো কী মাছ, কোন জাতি? আগে তো দেখিনি! এই মেলায় তাঁরাই নেই। মনে হয়, কলকাতার এত কাছের মেলাটা সম্পর্কে এখনও তাঁদের কেউ খবর দেয়নি!
তবে দেখা মিলেছে হুগলির হালিশহর থেকে আসা বিজ্ঞান পরিষদের সদস্যদের। তাঁদের অন্যতম দিলীপ চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘এই চত্বরে মোট পঞ্চান্নটা মাছের আর সতেরোটা কাঁকড়ার স্টল ছিল এ বার। কাঁকড়াগুলো কিন্তু এক দাঁড়ার। মানে কাঁকড়াদের দুটো দাঁড়ার মধ্যে একটা ধরার সময়ই ভেঙে গিয়েছিল। মেলায় এক দাঁড়া কাঁকড়াই বিক্রি হয়েছিল ষাট-সত্তর টাকা কিলো।’ দুটো দাঁড়ার কাঁকড়াদের নাকি আর এ দেশের বাজারে দেখাই যায় না। সব বিমানে চেপে চলে যায় বিদেশের বাজারে! সে নিয়ে দুঃখ দেখে মৎস্যবিক্রেতা নারায়ণ দাস হাসলেন, ‘দেশ-বিদেশ, যেখানেই যান, এত বড় আর এত রকমের মাছের দেখা কিন্তু আর কোত্থাও পাবেন না।’ |