|
|
|
|
প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ফোন মুখ্যমন্ত্রীর |
জিটিএ রূপায়ণে দিল্লি কেন পাশে নেই, ক্ষুব্ধ মমতা |
অনিন্দ্য জানা • শিলিগুড়ি |
দার্জিলিং পাহাড়ের জন্য জিটিএ চুক্তি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের সঙ্গে ‘সহযোগিতা’ করছে না বলে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ‘ক্ষোভ’ জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কেন্দ্রীয় সরকার যে ভাবে জিটিএ চুক্তির কিছু ‘খুঁটিনাটি’ বিষয় জানতে চেয়ে রাজ্যকে চিঠি লিখেছে, তাতেই ‘ক্ষুব্ধ’ মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার উত্তরবঙ্গ সফরে আসার আগে মমতা নিজে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ফোন করেছিলেন। এ দিন তিনি বলেছেন, “যখন ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছিল, তখন তো কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবও। কেন্দ্রও তো চুক্তিতে সই করেছে! সব জেনেই তো করেছে! তা হলে আবার এত প্রশ্ন কীসের?” মমতার কথায়, “প্রধানমন্ত্রীর দফতরকে বলেছি, জিটিএ নিয়ে কিন্তু কেন্দ্র আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছে না!”
গোর্খা টেরিটোরিয়াল অথরিটি (জিটিএ) নিয়ে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি সইয়ের পর সেটি রাজ্য বিধানসভায় বিল আকারে পাশ হয়ে গিয়েছে। তার পর সেটি পাঠানো হয়েছে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য। বৃহস্পতিবারই মুখ্যসচিব সমর ঘোষ জানিয়েছিলেন, জিটিএ চুক্তির সঙ্গে যে সমস্ত মন্ত্রক জড়িত, তারা কিছু বিষয়ে ‘প্রশ্ন’ তুলেছে। সেই প্রশ্নগুলি একত্রিত করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক (যে হেতু পাহাড়ের বিষয়ে ‘নোডাল এজেন্সি’ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক) রাজ্য সরকারকে একটি নোট পাঠিয়েছে। সমরবাবু জানিয়েছিলেন, রাজ্য সেই নোটের জবাব দেবে। প্রত্যাশিত ভাবেই, বিষয়টি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রশাসনের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা কথা বলেন। তার পরেই মুখ্যমন্ত্রীর সরাসরি ফোন নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে।
এক দিকে যেমন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রশ্ন, অন্য দিকে তেমনই গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা প্রধান বিমল গুরুঙ্গের ‘হুঁশিয়ারি’। আগামী ২৭ মার্চের মধ্যে বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হলে প্রকাশ্যে চুক্তির প্রতিলিপি পোড়ানোর কথা ঘোষণা করেছেন গুরুঙ্গ। মুখ্যসচিব ওই বিষয়ে কোনও মন্তব্য না করতে চাইলেও মুখ্যমন্ত্রী নিজে বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক অবহিত। ঘটনাচক্রে, আজ, শনিবার দুপুরে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গুরুঙ্গের দেখা করতে আসার একটা মৃদু সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে। তিনি এলে জিটিএ নিয়েই যে দু’পক্ষের আলোচনা হবে, তা-ও প্রত্যাশিত। অন্য একটি সূত্রের অবশ্য খবর, গুরুঙ্গ নিজে আসবেন না। এবং আসবেন না মুখ্যমন্ত্রীকে ‘বার্তা’ দিতেই। তাঁর বদলে আসবেন মোর্চা নেতা রোশন গিরি এবং হরকা বাহাদুর ছেত্রী। |
|
উত্তরবঙ্গ উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। শুক্রবার। ছবি: সন্দীপ পাল |
এক দিকে কেন্দ্র এবং অন্য দিকে গুরুঙ্গের জোড়া ‘অসহিষ্ণুতা’র জন্যই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ‘ক্ষুব্ধ’ বলে তাঁর ঘনিষ্ঠমহল সূত্রে বলা হচ্ছে।
বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, পুরো বিষয়টির পিছনেই আপাতত ‘কংগ্রেসের হাত’ দেখছেন মমতা। তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে এ দিন জানানো হয়েছে, মমতা তাঁর ‘উষ্মার’ কথা কেন্দ্রীয় অথর্মন্ত্রী তথা বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়কেও জানিয়েছেন। অধুনা রাজ্যকে বরাদ্দকৃত অর্থ নিয়ে কংগ্রেসের মুখপাত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভির সঙ্গে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের ‘চাপানউতোর’ চলছে। মমতা নিজে ওই বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য না করলেও তাঁর অনুমোদন সাপেক্ষেই যে অমিতবাবু সিঙ্ঘভির সঙ্গে তর্কযুদ্ধে জড়িয়েছেন, তা স্পষ্ট। ঘনিষ্ঠমহলে মমতা অতি সম্প্রতি এমন মন্তব্যও করেছেন যে, “প্রাপ্য অর্থ দিচ্ছে না। কিন্তু কংগ্রেস বড় বেশি রাজনীতি করছে!”
রাজধানীর উত্তরপ্রদেশ ভোট-পরবর্তী রাজনৈতিক সমীকরণ (অবশ্যই মুলায়ম সিংহ যাদবের সমর্থন সংক্রান্ত) নিয়ে তৃণমূলের অন্দরেও জল্পনা অব্যাহত। মমতা-ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, “কংগ্রেস ভাবছে, মুলায়ম ভাল ফল করবে আর ওদের তৃণমূল-নির্ভরতা কমবে। কিন্তু আমাদের ধারণা, উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস-মুলায়মের তেমন ভাল ফল হবে না।” তৃণমূল নেত্রী নিজেও জানেন, যে ভাবে তাঁর ‘আপত্তি’তে পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি, খুচরো পণ্যে বিদেশি লগ্নি বা জমি বিল আটকে গিয়েছে, তাতে কংগ্রেসের ‘খুশি’ হওয়ার কথা নয়। ফলে তিনিও কংগ্রেসকে ‘পাল্টা চাপে’ রাখার রাস্তা নিয়েছেন। জিটিএ চুক্তি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে সরাসরি ফোনে ‘ক্ষোভ’ জানানো এক দিকে যেমন তারই অঙ্গ, অন্য দিকে তা গুরুঙ্গদের প্রতিও ‘বার্তা’ যে, জিটিএ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ‘আন্তরিক’।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এ নিয়ে ষষ্ঠ বার উত্তরবঙ্গ সফরে এলেন মমতা। এ বারের আগমন উত্তরবঙ্গের ছ’টি জেলাকে নিয়ে প্রশাসনিক বৈঠক এবং একই সঙ্গে ছ’দিন ব্যাপী ‘উত্তরবঙ্গ উৎসবে’র উদ্বোধন। যে উৎসবে উত্তর এবং দক্ষিণবঙ্গ মিলিয়ে এ দিন মোট ১০ জন গুণিজনকে মানপত্র, উত্তরীয় এবং নগদ এক লক্ষ টাকা দিয়ে সংবর্ধিত করলেন মমতা। প্রথমেই সংবর্ধিত হলেন নেপালি ভাষায় সাহিত্যিক তথা পাহাড়ের বাসিন্দা ইন্দ্রবাহাদুর রাই। মমতা যে ‘ইচ্ছে করেই’ রাইকে প্রথমে রেখেছিলেন, প্রশাসনিক সূত্রেও তার সমর্থন পাওয়া গিয়েছে। ঠিক যে ভাবে তিনি উৎসবের মঞ্চে ডেকে নিয়েছিলেন রোশন এবং হরকা বাহাদুরকে। সংবর্ধনা দেওয়া হল পাহাড়ের মানুষের কাছে ‘আইকন’ প্রাক্তন জাতীয় ফুটবল অধিনায়ক ভাইচুং ভুটিয়াকেও। আশ্চর্য নয় যে, গায়ক-সুরকার-গীতিকার নচিকেতা চক্রবর্তীর মতোই কনকনে শীতের ভরা কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে (আচমকাই তাপমাত্রা নেমে গিয়ে ব্যাপক ঠান্ডা পড়েছে শিলিগুড়িতে। এতটাই যে শীতবস্ত্র না নিয়ে মঞ্চে-ওঠা মুখ্যসচিব সারা ক্ষণই প্রায় বুকের উপর আড়াআড়ি দু’হাত রেখে গুটিসুটি হয়ে বসে রইলেন আর গাড়ি থেকে গরম চাদর আনাতে হল মুখ্যমন্ত্রীকে) হর্ষধ্বনি উঠল ভাইচুংকে দেখে। |
|
উত্তরবঙ্গ উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গান গাইছেন মুখ্যমন্ত্রী।
সঙ্গে অভিনেত্রী জুন মালিয়া ও সন্ধ্যা রায়। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক |
উৎসবের বক্তৃতায় পাহাড় এবং সমতল সংক্রান্ত নিজের ‘লাইন’ আরও এক বার বললেন মুখ্যমন্ত্রী। বললেন, “বিভেদ নয়। ঐক্য চাই। আমি কোনও রকমের বিচ্ছিন্নতাবাদ সমর্থন করি না। যারা পাহাড়কে বিচ্ছিন্ন করতে চায়, যারা তরাই-ডুয়ার্সকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়, তাদের আমি পছন্দ করি না।” বললেন, “উন্নয়ন দিয়ে আমি পাহাড়-সমতলকে এক রাখব। কাউকে কারও থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেব না। পাহাড়-সমতলকে এক রাখতেই হবে!” যে বক্তব্য, আশা করা যায়, অনুষ্ঠানস্থলে না থাকলেও গুরুঙ্গের কাছে পৌঁছে যাবে রোশন গিরিদের মারফত। জানালেন, দার্জিলিংকে সুইৎজারল্যান্ড বানানোর জন্য একটি আলাদা ‘মাস্টার-প্ল্যান’ তৈরি হচ্ছে। জানালেন, উত্তরবঙ্গের ছ’টি জেলার মধ্যে দার্জিলিং এবং কোচবিহারকে ‘পশ্চাদপদ’ জেলার তালিকাভুক্ত করার জন্য তিনি স্বয়ং চেষ্টা চালাচ্ছেন।
এ ছাড়া?
এ ছাড়া মুখ্যমন্ত্রী যা বললেন, দেখেশুনে মোবাইল সংস্থার সাম্প্রতিকতম বিজ্ঞাপনের কথা মনে হচ্ছিল। সেই যে সমস্ত রকম ভাল থেকে বেছে বেছে নিয়ে সমস্ত ভালর মিশ্রণে একটা সর্বোত্তম প্যাকেজ নিজের জন্য তৈরি করে নেওয়া। উৎসবের মঞ্চ থেকে দূরনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে মোট ন’টি প্রকল্পের ‘শুভারম্ভ’ (কোনওটির শিলান্যাস, কোনওটির সূচনা) করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার মধ্যে রাজবংশী অ্যাকাডেমি, তথ্যপ্রযুক্তি হাব, পঞ্চায়েত কর্মীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কোচবিহারে আতাবাড়ি ঘাট থেকে সেতু, প্রতি জেলায় সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতর, উত্তরবঙ্গের জন্য মিনি সচিবালয়, শিলিগুড়িতে ১০০ শয্যার হাসপাতাল, ৭৫ একর জমিতে ফিল্মসিটি, ছাত্র এবং ছাত্রীদের জন্য আলাদা করে পলিটেকনিক কলেজ, দার্জিলিং এবং ডুয়াসর্কে মিলিয়ে পর্যটন-বিনোদন-উন্নয়ন কী নেই!
যে ঘোষণা বলছে, সব ভাল থেকে নিয়ে-নিয়ে উত্তরবঙ্গের জন্য ‘সর্বোত্তম প্যাকেজ’ করবেন মুখ্যমন্ত্রী।
স্বাভাবিক। হর ফ্রেন্ড জরুরি হোতা হ্যায়! পাহাড় থেকে সমতল। গোর্খা থেকে আদিবাসী মুখ্যমন্ত্রী
মমতার কাছে এখন প্রত্যেক বন্ধুই অপরিহার্য।
জরুরি। |
|
|
|
|
|