পূর্ব কলকাতা
শিকেয় অগ্নি-বিধি
সরু সুতোয় পা
মরি-কাণ্ডের পরে অগ্নি-সুরক্ষা নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। বিভিন্ন পুর এলাকায় বহুতলের সুরক্ষা খতিয়ে দেখতে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। কিন্তু দমদম এবং দক্ষিণ দমদমের বিস্তীর্ণ এলাকায় বেশির ভাগ বহুতলেরই ন্যূনতম অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই বলে এলাকার মানুষই অভিযোগ করেছেন। এই নিয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে অভিযোগও জমা পড়েছে।
যেমন, বিমানবন্দরের ১ নম্বর গেটের কাছে একটি বহুতলের কথাই ধরা যাক। ওই আবাসন তৈরির কয়েক বছর পরেই তার একটি তলা বদলে যায় রেস্তোরাঁয়। অভিযোগ ওঠে, তা নির্মাণ হচ্ছে অগ্নিবিধি অমান্য করেই। এই রেস্তোরাঁয় ঢোকা ও বেরনোর পথ একটাই। তিন ফুট চওড়া সিঁড়ি। আর এই বহুতলের গা ঘেঁষেই রয়েছে দু’টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সফর্মার। কিন্তু সে সব বিপদের আশঙ্কা উপেক্ষা করেই রেস্তোরাঁ বানানো হচ্ছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ।
ওই আবাসনের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ফ্ল্যাট কেনার সময়ে এই রেস্তোরাঁ তৈরির কথা তাঁদের জানানো হয়নি। অনুমোদিত নকশাতেও বাড়িটির দু’টি তল বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার করার কথা বলা ছিল। কিন্তু মাস কয়েক আগে হঠাৎই দেখেন, দোতলার ফ্ল্যাটটিতে একটি রেস্তোরাঁর কাজ শুরু হয়েছে। বাতানুকূল ওই রেস্তোরাঁ বানাতে গিয়ে গাঁথনি তুলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সব জানলা। রেস্তোরাঁর সিঁড়ি একটিই। অথচ, দমকল সূত্রের খবর, রেস্তোরাঁ থাকলে দু’টি সিঁড়ি থাকা বাধ্যতামূলক। ওই বহুতলের বাসিন্দাদের আশঙ্কা, ওই রেস্তোরাঁয় এক বার আগুন লাগলে গোটা বহুতলটিই পুড়ে যাবে। বিষয়টি নিয়ে তাঁরা পুরসভা এবং দমকলে অভিযোগও জানিয়েছেন।
ওই আবাসনের বিষয়ে পূর্ত দফতরের এক ইঞ্জিনিয়ার বলেন, “ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী, নকশায় বাণিজ্যিক হিসেবে দেখানো হলেও তাতে রেস্তোরাঁ বা ব্যাঙ্কোয়েট হল তৈরি করা যায় না। সে ক্ষেত্রে ‘অ্যাসেম্বলি টাইপ অফ বিল্ডিং’-এর অনুমোদন নিতে হয়।” ওই আবাসনের প্রোমোটার পিন্টু বসুও জলাধার তৈরি না করার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁর কথায়, “পুরসভা অনুমতি দেয়নি বলেই জলাধার তৈরি করা হয়নি।” পাশাপাশি, বাণিজ্যিক কারণ দেখিয়েই যে তিনি রেস্তোরাঁ মালিককে একটি তল বেচেছেন, তা-ও স্বীকার করে নিয়েছেন ওই প্রোমোটার। রেস্তোরাঁ নির্মাণের আগে দমকলের অনুমতি নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে ওই রেস্তোরাঁর মালিক অভিষেক সাহার মন্তব্য: “সে কথা আপনাদের বলব কেন?” পরে তিনি বলেন, “যখন আইনে আটকাবে, তখন দেখা যাবে।” এ ব্যাপারে দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান সঞ্জীব চন্দ বলেন, “ওই বহুতলের সমস্যার কথা আমার জানা। কিন্তু লিখিত অভিযোগ হাতে পাইনি।” তবে তাঁর আশ্বাস, “এ ধরনের কোনও ঘটনা ঘটলে পুরসভা কড়া ব্যবস্থা নেবে।” দমকলের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক জানান, রেস্তোরাঁ নির্মাণের আগে দমকলের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।
এটি একটি বিচ্ছিন্ন উদাহরণ মাত্র। অগ্নিবিধি উপেক্ষা করেই একের পর এক বহুতল গড়ে উঠছে দমদম এবং দক্ষিণ দমদম পুর এলাকায়। অভিযোগ উঠেছে, এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন সম্পূর্ণ নীরব। এলাকায় একের পর এক বহুতল গড়ছেন প্রোমোটারেরা। কিন্তু অগ্নি-নিরাপত্তা দূরে থাক, জলাধারও তৈরি করা হচ্ছে না আবাসনগুলিতে। জল সরবরাহে ব্যবহার করা হচ্ছে সাব-মার্সিবল পাম্প। কোথাও বা ঘুপচি গলির ভিতরেই পুর আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গজিয়ে উঠছে ‘বেআইনি’ তলা। স্থানীয় বাসিন্দাদের আশঙ্কা, ওই সব বহুতলে আগুন লাগলে দমকল আসার আগেই বড়সড় বিপদ ঘটে যেতে পারে।
অগ্নিকাণ্ড কিন্তু ওই দুই পুরসভার ক্ষেত্রে নতুন নয়। দমদম গোরাবাজারেই বছর কয়েক আগে এক ভয়াবহ আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছিল মাছ-সব্জির বাজার। ন্যূনতম অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকায় পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল শ’খানেক দোকান। কিন্তু তার পরেও ওই এলাকার অগ্নি নিবার্পণ ব্যবস্থা নিয়ে প্রশাসনের টনক নড়েনি। উল্টে দমদম এবং দক্ষিণ দমদম পুর এলাকায় নিয়ম ভেঙেই বহুতল গড়া চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকী, বহুতল আবাসনের বৈদ্যুতিক মিটার রাখা হচ্ছে বিপজ্জনক জায়গায়।
দিন কয়েক আগেই দক্ষিণ দমদম পুরসভার ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের একটি বহুতলের মিটার বক্সে আগুন লেগেছিল। বহুতল বানানোর ক্ষেত্রে যে ন্যূনতম ছাড় দেওয়ার কথা রয়েছে, তা-ও মানা হচ্ছে না। গা ঘেঁষাঘেষি করে যে ভাবে বহুতলগুলি গজিয়ে উঠছে, সেটাও বিপজ্জনক বলে অভিমত স্থানীয় বাসিন্দাদের। এক পুরকর্মীর কথায়: “একটি বাড়িতে আগুন লাগলে তা অন্য বাড়িতেও ছড়িয়ে পড়বে। নির্ধারিত ছাড় থাকলে এই বিপদ থেকে দূরে থাকা সম্ভব।”
এই এলাকার একাধিক প্রোমোটারও মেনে নিয়েছেন ‘নিয়ম ভাঙার’ কথা। তাঁরা জানান, এলাকার বেশির ভাগ বহুতলেই জলাধার গড়া হচ্ছে না। সাধারণ মানুষ আগুন নিয়ে মাথা না ঘামানোর সুযোগেই দেদার বিকোচ্ছে সেই সব ফ্ল্যাটবাড়ি। এলাকার বিভিন্ন ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দারাও জানান, তাঁরাও অনেক ক্ষেত্রে বিষয়টি না জেনেই ফ্ল্যাট কিনেছেন। প্রশান্ত দাস নামে এক বাসিন্দার কথায়: “জলাধার না থাকায় কী বিপদ হতে পারে তা প্রথমে বুঝতে পারিনি। তা হলে এখানে ফ্ল্যাট কিনতাম না।”
দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান দাবি করেছেন, “অগ্নি-সুরক্ষা নিয়ে পুরসভা ভাবনাচিন্তা করছে।” পাশাপাশি, দক্ষিণ দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান অঞ্জনা রক্ষিত বলেন, “সাম্প্রতিক আমরি-কাণ্ডের পরে একটি দল তৈরি করে বিভিন্ন আবাসন পরিদর্শন করা হচ্ছে। বহুতল তৈরির সময় জলাধার নির্মাণও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।” কিন্তু সেই নিয়ম তৈরির আগেই যে বহু আবাসন বিপজ্জনক ভাবে তৈরি হয়ে গিয়েছে, তা মেনে নিয়েছে দুই পুরসভাই।
দমকলের ডিরেক্টর জেনারেল দুর্গাপ্রসাদ তারেনিয়া বলেন, “শহরতলিতে অনেকেই আইন মানছেন না। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে। তবে, নিজেদের সুরক্ষার জন্যই দমকল আইন মেনে চলা জরুরি।”




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.