প্রতি পক্ষ
মুক্তি পেলেন না রবিঠাকুর

তিনি বাঙালি, নিবাস বাংলাদেশ, কিন্তু বছরের অনেকটাই কাটে বিদেশে, নাটক নিয়ে নানা নিরীক্ষায়। তিনি নয়াদিল্লির এন এস ডি, ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার উজ্জ্বলতম শিক্ষার্থীদের এক জন। অতঃপর বিলেত থেকে নাট্যবিদ্যায় ডক্টরেট।
অথচ, জামিল আহমেদকে এ সব কিছুই স্পর্শ করে না তেমন ভাবে। বেশভূষা এবং চালচলনে কোনও অলৌকিক দ্যুতি নেই। শুধু, কথা শুরু হলে বোঝা যায়, ভিতর থেকে ঝিকিয়ে উঠছে একটি আলো। সেই আলো, তাঁর দৃষ্টির মতই ঋজু। জামিল অকারণ প্যাঁচালো বাক্যবিন্যাস করেন না। যা বিশ্বাস করেন, তাই বলেন। এবং, সোজা ভাবে বলেন। তাই, আলাপের মধ্যে যখন জিজ্ঞেস করা হল, কলকাতায় এসেছেন তো বেশ কিছু দিন, টিভি খুলে কোনও ধারাবাহিক, মানে সিরিয়াল-টিরিয়াল চোখে পড়েছে, জামিল শান্ত কণ্ঠে বললেন, “পড়েছে। ওই দু-এক বার...”
কেমন লাগল?
“আমি অভিনয়ের দিকটা বলতে পারি। সেটা খুবই খারাপ।”
জামিল আহমেদ সেই বিরল ব্যক্তিদের একজন যাঁরা যে কোনও একটা মন্তব্য করেই ক্ষান্ত হন না, যুক্তি দিয়ে তাঁর মতটি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। প্রশ্ন করতে হল না, জামিল নিজেই বললেন, “আমি দেখলাম, জানেন, এক জন বলছে, অবিকল মনে নেই, কিন্তু কথাটা মোটামুটি এ রকম, আমি অমুকখান থেকে এখানে এলাম, আর তুমি তমুক জায়গায় চলে গেলে...এই ধরনের কিছু একটা। আশ্চর্য, সে বলার সময় রীতিমতো আঙুল নাচিয়ে অমুকখান, এখান আর তমুকখান তিনটে জায়গাকেই নির্দেশ করে দেখাল। সংলাপকে এমন বিচিত্র ভাবে ফিজিক্যালাইজ করা...খুব সংক্ষেপে বললে, হাস্যকর!”
জামিল হেসেই ফেললেন, তার পরে বললেন, “ফিজিক্যাল অ্যাক্টিংয়ের কথা বলছি না কিন্তু, সেটা অন্য জিনিস।”
অভিনয়ের পরিভাষা যদি কথাবার্তার ফাঁকে চলকে ওঠে কোথাও, অবাক হওয়ার কারণ নেই। জামিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যচর্চা বিভাগের অধ্যাপক। নিজেও নাটক শিখিয়ে বেড়ান গোটা দুনিয়া জুড়ে। এবং, যদি কলকাতার নাটকের কথা ওঠে, জামিল আহমেদ নির্দ্বিধায় বলবেন, “এখানে যেটা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, তা হল উচ্চারণ। এত স্পষ্ট উচ্চারণ, গড়পড়তা ছোটবড় প্রায় সব দলের অভিনয়েই যা পাওয়া যায়, সেটা খুবই বিস্ময়কর। ভারত ছেড়েই দিন, পৃথিবীর খুব কম জায়গাতেই মঞ্চের অভিনেতাদের এত স্পষ্ট উচ্চারণে সংলাপ বলতে শুনেছি।”
আর, অস্বস্তি লাগেনি কোথাও?
“লেগেছে,” স্বভাবসিদ্ধ শান্ত ভাবে বললেন জামিল, “সবাই নয়, সবার সম্বন্ধে মন্তব্য করার অধিকার আমার নেই, আর ব্যতিক্রম তো সব জায়গাতেই থাকে, কিন্তু মোটের ওপর আমার মনে হয়েছে, এখানে অধিকাংশ অভিনেতা তাঁদের ‘ফেস’, মানে মুখমণ্ডলটাকে যতটা ব্যবহার করছেন, শরীরের বাকি যে অংশটুকু, সেটা বোধহয় ততটা ব্যবহার করছেন না। অথচ, অভিনয়ের সময় সেটাও কিছু কম জরুরি নয়।”
জামিল আহমেদ এমনই স্পষ্টভাষী। সাক্ষাৎকারের সময় তিনি অকারণে সন্ত্রস্ত থাকেন না। কারণ, তাঁর প্রতিটি উচ্চারিত শব্দের পিছনে থাকে তাঁর নিজস্ব প্রত্যয়। সুতরাং, তাঁকে তো কয়েকটা বিতর্কিত প্রশ্ন করাই যায়।
তেমনই একটি বিষয় রবীন্দ্রনাথ। নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ। আনন্দবাজারেই কয়েক বছর আগে একটি সাক্ষাৎকারে গিরীশ কড়নড় বলেছিলেন, উনিশশো পঞ্চাশ পর্যন্ত তা-ও ঠিক আছে, কিন্তু স্বাধীনতার পরে আধুনিক ভারতীয় নাটকের কথা তুললে নাট্যকার রবীন্দ্রনাথকে বিরাট কোনও স্থান দেওয়ার অর্থ নেই। ঠিক সেই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসাবে নয়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নাটককে আপনি কী ভাবে দেখেন?
জামিল আহমেদ আপাতত রবীন্দ্রনাথ নিয়েই কাজ করছেন, অতএব এই মুহূর্তে তিনি রবীন্দ্রনাথে অনেকটাই মগ্ন। ঈষৎ হেসে জামিল বললেন, “আমার মতে, নাট্যকার হিসাবে রবীন্দ্রনাথ মোটেও উঁচু দরের নন।”
যথারীতি, নিছকই মন্তব্য নয়, পিছনে ঝকঝক করে উঠল তাঁর যুক্তি।
জামিল বললেন, “নাটকের ক্ষেত্রে কিন্তু তার স্ট্রাকচারটা, অর্থাৎ নাটকের গড়নটাকে ঠিকঠাক করে তৈরি করা খুব জরুরি। সমস্ত মহৎ নাটকের ক্ষেত্রেই সেটা আছে। রবীন্দ্রনাথে সেই জিনিসটার অভাব খুব স্পষ্ট। আবার, এটাও ঠিক যে, ওই সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি নিজের মতো করে একটা পথ খুঁজেছিলেন। খুঁজতে চাইছিলেন। নিজেকে ভাঙতে চাইছিলেন। ভাবুন, জাভা দ্বীপে গিয়ে নাচ দেখে নৃত্যনাট্য লেখার কথা মনে হল। এই উদ্যম, এই সাহস এবং এই সৃষ্টিশীলতা বিস্ময়কর। কিন্তু, তার মানে এই নয় যে, নাটকগুলো কালজয়ী হল। কারণ, নাটক থেকে দর্শক কী আশা করে বলুন তো?”
কী?
“একটা কোনও ঘটনা, এবং সেটা এগোবে। কী ভাবে এগোবে, তার কোনও ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। মঞ্চে স্রেফ একটাই হয়তো চরিত্র, তবুও সেটা এগোতে পারে। রবীন্দ্রনাথের নাটকের ক্ষেত্রে সেই জিনিসটা কি খুব দেখা যায়?”
কিন্তু, একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথের নাটক মুখ্যত ভাবপ্রধান। সেখানে বাহ্যিক ঘটনার ওপর জোর পড়ে কম।
“কোন মহৎ নাটক ভাবপ্রধান নয় বলুন তো? জামিল হেসে ফেললেন, ভাব তো থাকতেই পারে, কিন্তু ভাবপ্রধান বলে আপনি নাটকের বাঁধুনিটাকে আলগা করতে পারেন কি? মঞ্চে আপনি এক বার যা নিয়ে আসছেন, চরিত্র তো বটেই, ধরা যাক রুমালের মতো ছোটখাট কোনও ‘প্রপার্টি’, সবারই, সব জিনিসেরই একটা নির্দিষ্ট গতি আছে। সেই গতির মধ্যে দর্শকেরা জড়িয়ে যায়। কিছু ক্ষণের জন্য যে যার নিজের জীবন থেকে বেরিয়ে এসে মঞ্চের ওই নাট্যমায়ার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে।”
সেটা কি রবীন্দ্রনাথের নাটকের ক্ষেত্রে হয় না?
জামিল আহমেদ জানলাপথে একটি গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তার পরে বললেন, “এই যে আইডেন্টিফিকেশন, তা নানা ভাবে ঘটতে পারে। উপন্যাস থেকে হতে পারে, গল্প থেকে হতে পারে, নাটক থেকেও হতে পারে। আপনি যখন উপন্যাস, কবিতা বা গল্প না লিখে নাটক লিখছেন, তখন আপনাকে নাট্য-রচনার কয়েকটা শর্ত তো মানতেই হবে। মজাটা কী জানেন, আমরা রবীন্দ্রনাথকে কয়েকটা খোপে দিব্যি পুরে ফেলেছি! জন্মের দেড়শো বছর পেরিয়ে গেল, অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সবচেয়ে কাঙ্খিত বস্তুটিই পেলেন না।”
কী সেই বস্তু?
“মুক্তি।”
জামিল আহমেদ হাসলেন। দূরে কোথাও সরস্বতী পুজোর মণ্ডপ থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে আসছিল। জামিল আনমনা হলেন, “কী আশ্চর্য সব গান, ভেবে দেখুন...”




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.