ব্যাগ গুছিয়ে...
আলো-আঁধারির ওখরে
য়ন বলে চলেছে আর আমি লিখছি। বিস্কুট, কড়াইশুটি সেদ্ধ, লিচু, অজ্ঞাত কৃষ্ণ-কন্দুক, অজ্ঞাত শ্বেত-কন্দুক, আলুবখরা, কলা, চিনেবাদাম, আধপোড়া আলুসেদ্ধ, শুকনো মুড়ি, নুডল্স, মটরভাজা, আখের টুকরো, কিশমিশ, শুকনো খেজুর, অভিনব আকৃতির নিমকিভাজা, চকোলেট, পাঁউরুটি এক একটি পলিব্যাগে গুনে গুনে আঠারোটি আইটেম। কন্দুক বলতে ওই রবার বলের মতো বিচিত্র সাদা-কালো গোলা দুটোর একটাও আমরা চিনি না। জানা গেল, গোলাকৃতি মণ্ডদুটোই আসলে ভগবান বুদ্ধের প্রসাদ।
প্রসাদের বাদবাকি ষোড়শ অনুষঙ্গে যে বৈচিত্র, তা আমাদের সব রকমের অভাব নিঃশেষে মিটিয়ে দিল। উৎসবের দিন, দুপুরের খাওয়াটাও মনাস্ট্রিতেই জুটেছে।
কলকাতার দুই অনাহূত অতিথি পেয়ে ওঁরা শোরগোল করে হাঁক পেড়ে খাইয়েছেন। আট-দশটি পদের মধ্যে ভাত ছাড়া কিছুই ভালমতো চিনি না। ডিমের তরকারিটা পর্যন্ত কী এক অনাস্বাদিতপূর্ব ব্যঞ্জনে রাঁধা। পেট পুরে খেয়ে, পুজো দেখে, তার পরে এই পলিব্যাগের ছাঁদা হাতে বিদায়। শীতের দেশে সন্ধে পড়লেই নাই কাজ তার খই ভাজ! পরম বিস্ময় নিয়ে ছাঁদার ফর্দ লিখে যখন জানলায় এসে দাঁড়ালাম, চরাচর আলো করে বুদ্ধপূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। দক্ষিণ দিগন্তে শৈলমালার মাথায় মাথায় বিন্দু বিন্দু আলো যেখানে এক রাশ জোনাকির মতো ঝাঁক বেঁধেছে, সেখানে রাতের দার্জিলিঙের বিলাসী অবয়ব এক এক বার ফুটে উঠেই আবার ঢেকে যাচ্ছে গভীর কুয়াশায়। পায়ের কাছে রাম্মাম নদীর উপত্যকায় গড়িয়ে নামছে থোকা থোকা মেঘ। রান্নাঘর থেকে নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়ছে গরম রুটি আর মন-কেমন-করা সুরুয়ার গন্ধ। এই নিঝুম ভাললাগার পরিসরে ঝাল, ঝোল, এই সব সহজ শব্দগুলোর বদলে সুরুয়াটাকেই যেন বেশি কাছের শব্দ বলে মনে হয়। ভিজে বেড়ালের বাসনা বুকে ভরে উনুন খুঁজি।
ভোরের সূর্য কালিম্পং পাহাড়ের পিছন থেকে ছাড়া পেয়ে দার্জিলিং আর নামচির মাঝ বরাবর রামাম নদীর গিরিখাত ধরে মেঘ ঠেলে ঠেলে এগিয়ে আসছে। উপত্যকা, অধিত্যকায় আলো-আঁধারির মায়ার খেলা। একরাশ ছেলেপুলে স্কুলব্যাগ পিঠে ফেলে পাহাড় ভাঙছে। ওখরের স্কুলটা বেশ বড়সড়। স্কুলমাঠের ধার ধরে রডোডেনড্রনের সারি। মার্চ-এপ্রিলে ফুলের বন্যা। আরও কিছুটা উঠে গেলে দু-দুটো মনাস্ট্রি। প্রথমে পুরনো গুম্ফা, তার পরে আরও তিন-চারশো মিটার উঠে গিয়ে নতুন গুম্ফা। অন্যান্য রাস্তাঘাটও বিশেষ নেই। বেশির ভাগ পাহাড়ি গ্রামগঞ্জের মতো একটাই পাকা সড়কের দু’পাশে পাহাড়ের গা ধরে উঠে-নেমে বসতি। দুটো নতুন রাস্তা আছে মনাস্ট্রিমুখী।
ট্যুরিস্টদের যাতায়াত শুরু হওয়ার পরে ওখরে একটু নড়েচড়ে বসেছে। না হলে সিকিমের আর দু’-দশটা গ্রামের মতোই নিপাট শান্তির পরিবেশ। দু’পা আগে-পিছনে গ্রাম আর জঙ্গলের মিশেল, তাই হরেক পাখি আর প্রজাপতি। টুকরো জমিতে বাঁধাকপির খেত আর পিঠে টুকরি বাঁধা গাঁয়ের হাসিখুশি মেয়েরা। হিলেরিবধির দিকে যে পাকা রাস্তাটা উঠে গেছে, এপ্রিল-মে মাসে তার দু’ধারে ঝোপেঝাড়ে টুকটুকে লাল বুনো স্ট্রবেরি আর গাছের ডালে স্থলপদ্মের মতো ফুটে থাকা থোকা থোকা চাঁপ।
যে দিকে তাকাও খালি পাহাড় আর পাহাড়। দার্জিলিঙের ডাইনে পাহাড়ের যে বড় ঢালটা, ওই ঢালের গা বেয়ে উঠে গেছে সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কের রোডরুট। ওই একই পাহাড়ের গোড়ায় ওখরের ঠিক উল্টো দিকে রাম্মাম নদীর ওপারে ছোট্ট জনপদ রিমবিক। ঢালের মাথার কাছে মেঘমা, আর আরও ডাইনে যে বিরাট উঁচু পাহাড়ের চুড়োটা ওটাই হল পশ্চিমবঙ্গের সব থেকে উঁচু বিন্দু সান্দাকফু। আরও অনেকটা ডাইনে গেলে ওই ফাঁকামতো চুড়োটা হল ফালুট, ফালুটের উপরে পশ্চিমবঙ্গ, নেপাল আর সিকিমের ত্রিবিন্দু। ট্যুরিস্টদের একটা বড় অংশ তবু পাহাড় দেখতে চায়। এই পাহাড় বলতে শুধুই কাঞ্চনজঙ্ঘা। ওখরের অবস্থান পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালে, তাই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে হলে যেতে হবে হিলে হয়ে বার্সে, আর তা নয়তো ওখরে থেকে সরাসরি পাহাড়ের মাথায় উঠে লামাসিং। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ছেড়ে থাকতে রাজি হলে ওখরে বড়ই সুখের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। মেঘ-কুয়াশায় গা ভাসিয়ে শুধুই ছুটি আর ছুটি।

কী ভাবে যাবেন
শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি ভাড়া করে অথবা শেয়ার-গাড়ি বা বাসে সিকিমের জোড়থাং বা নয়াবাজার (৮২ কিমি)। সেখান থেকে আবার একই ভাবে শেয়ার-গাড়ি বা বাসে ওখরে (৪৫ কিমি)। শেয়ার-গাড়িতে বলতে যেগুলো পাহাড়ি রাস্তায় শেয়ারে চলে। গাড়ি পুরোপুরি ভাড়া করে নিলে বড় গাড়ি বেছে নেওয়াটাই ভাল। বাস অনিয়মিত আর সংখ্যাও খুব কম, তাই শেয়ার-গাড়ির উপরে নির্ভর করাটাই সুবিধাজনক হবে।
কী নেবেন
পর্যাপ্ত গরম পোশাক এবং ওষুধ ছাড়া আর কিছু ব্যাগে ভরাটা একান্ত জরুরি নয়।
কোথায় থাকবেন
বেসরকারি হোটেল বা লজে। সব ক’টি লজেই সরাসরি গাড়ি যায়, ফলে বয়স্ক মানুষও সহজেই পৌঁছতে পারেন। বিদ্যুৎ সংযোগ আর মোবাইল পরিষেবা আছে। ওখরে থেকে বার্সে অভয়ারণ্য ঘুরে আসার ব্যবস্থাও হতে পারে অনায়াসে। বার্সে থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে বার্সের গুরাস কুঞ্জে অন্তত একটি রাত কাটিয়ে আসা উচিত।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.