পুলিশকে সেদিন নিশানা খুঁজতে হয়নি। টের পাওয়া মাত্রই চার তলার ঘুপচি ঘর থেকে ধেয়ে এল প্রথম গুলিটা। আর তার পরের দশ মিনিট এলোপাথাড়ি ঝলসে উঠল কম্যান্ডোদের কারবাইন-কালাশনিকভ।
তার পর সব শান্ত।
রক্তাক্ত মেঝেতে পড়ে রইল আতিফ ও সাজিদের ঝাঁঝরা শরীর। দশ বাই দশের দেওয়ালও ততক্ষণে ঝাঁঝরা। এমনকী সবার অজান্তে জানলা গলে একটা গুলি আছড়ে পড়ল প্রায় আটশো কিলোমিটার দূরে। সেই এক গুলিতেই ‘রাজা সাহাব কা কিলা’ কাত। আদুড় গায়ে আজও কুঁকড়ে রয়েছে সে। গায়ে সাঁটা সাইনবোর্ডে বড় বড় হরফে লেখা, ‘সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর’।
রজনীকান্তের হালফিলের কোনও ছবি নয়। এই চিত্রনাট্যে যেটুকু অতিনাটকীয়তা, তা স্রেফ কাহিনির স্বার্থে। আটশো কিলোমিটার অতিক্রম করা গুলি আর সাইনবোর্ডটাই যা শুধু কাল্পনিক!
কাল্পনিকও কি? কলকাতায় বসেও গুগ্ল খুঁজে দেখতে পাবেন, ‘আজমগড় দ্য নার্সারি অফ টেরর।’
ঠিক যেমন এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় দিল্লির জামিয়া নগরের বাটলা হাউস। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৮-এর সকাল। তার ছ’দিন আগেই ধারাবাহিক পাঁচটি বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল দিল্লি। ইনস্পেক্টর মোহনচাঁদ শর্মার নেতৃত্বে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে বাটলায় ঢুকল দিল্লি পুলিশের কম্যান্ডো বাহিনী। আধ ঘণ্টা পর লাশ বেরলো দুই সন্ত্রাসবাদীর।
উত্তরপ্রদেশ ভোট সফরে বেরিয়ে এখানে আসব, পরিকল্পনা ছিলই। কিন্তু নয়াদিল্লি স্টেশনে যা ঘটল, আগাগোড়া কাকতালীয়। চোদ্দো নম্বর স্টেশনে জলের কলের দিকে তাকিয়ে আটকে গেল চোখ। অর্ধেক ছেঁড়া সাদা-কালো পোস্টার। যেটুকু পড়া যাচ্ছে, তার সার কথা, খোঁজ দিলে ‘ইনাম’ দেবে পুলিশ। গালে খোঁচা দাড়ি, বছর পঁচিশেক বয়সের একটি ছেলের ছবি। মির্জা সাহেব বেগ। পিতা মির্জা এহসান বেগ। জিলা আজমগড়, মহল্লা ‘রাজা সাহাব কা কিলা’। |
আজমগড় জায়গাটা এমনিতে পূর্ব উত্তরপ্রদেশের আর পাঁচটা আধা মফস্বলের মতোই। হলুদ, সবুজ সর্ষে ক্ষেত। মাঝে মাঝে ছোট ছোট জনপদ। পলেস্তারা ছাড়া ইট বের করা বাড়ি। ব্যস্ত হাট, বাজার। অগুনতি মসজিদ,মাদ্রাসা। এবড়ো খেবড়ো রাস্তা, দিনে ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং সব এক। তবু এ যেন এক অন্য গ্রহ।
মির্জা বেগ পলাতক। মহম্মদ সাজ্জাদ নিখোঁজ। ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে ধরা পড়েছে আরও এক ডজন। বাটলার সূত্র ধরে পুলিশ আজমগড়ের বাসিন্দা মসিউদ্দিনের দুই ছেলেকে খুঁজছে। আজমগড় মুখ লুকোবে কোথায়? মসিউদ্দিনের ঠিকানা জানতে চাইতেই এক ছুটে পালিয়ে যায় সে।
অথচ আজমগড়ের পড়াশোনায় মন ছিল। খুব ভাল ক্রিকেট খেলত আতিফ নিজে। পূর্বাঞ্চলের ভাল কলেজগুলির মধ্যে নাম ছিল শিবলি স্নাতকোত্তর কলেজের। এবং আজও উর্দু পঠনপাঠনের পীঠস্থান শিবলি আকাডেমি। “কিন্তু সন্ত্রাসের তকমা এতটাই ভারী হয়ে উঠেছে যে, এখানকার ছেলেমেয়েদের বাইরে চাকরি পাওয়াটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চান্সই পায় না। বিশেষ করে মুসলিমরা,” আক্ষেপের সঙ্গে জানালেন শিবলির শিক্ষক উমের নাদভি। কলেজের ম্যানেজার মির্জা মেহফুস বেগেরও ভারাক্রান্ত মুখ। জানালেন, “এখানকার মানুষ চাইলেও পাসপোর্ট পায় না। সবাইকেই সন্দেহের চোখে দেখে পুলিশ। এ যেন তালিবানি সাম্রাজ্য। খোঁজ নিয়ে দেখুন।” পরক্ষণেই পাল্টা প্রশ্ন, বেনারস থেকে আসার সময় এক কথায় ট্যাক্সি পেয়েছিলেন?
আজ বলে নয়, সন্ত্রাসের সঙ্গদোষ আজমগড়ের অনেক দিনই। সদর থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে এই আজমগড়েরই সন্তান আবু সালেম। ১৯৯৩ সালের মুম্বই বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত। আবার শ্বশুরবাড়ির সূত্রে আজমগড়ের সঙ্গে যোগ রয়েছে দাউদ ইব্রাহিম এবং হাজি মস্তান মির্জারও।
কিন্তু সে সব ছিল বিক্ষিপ্ত ঘটনা। ‘বিতে হুয়ে দিন’কে পিছনে ফেলে রেখেই এগোচ্ছিল আজমগড়। এখানকার ছেলেমেয়েরা ভাল ফল করছিল। ফের পা টেনে ধরল বাটলা হাউস। সানজারপুর গ্রামে মসিউদ্দিনের দাওয়াতে বসে কথা হচ্ছিল। দুই ছেলে বাটলা ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত। গেলাসে জল দিতে এসে এখনও আড়ষ্ট হয়ে থাকেন মসিউদ্দিনের বেগম। বুঝে নিতে চান, পুলিশ নয় তো!
আজমগড় এ সবের থেকে মুক্তি চায়। কাল ভোট। আজও বিভ্রান্তি যেন গ্রাস করছে। কাকে ভোট দেবে?
বাটলা ‘এনকাউন্টার’কে ভুয়ো বলে দেগে দিয়েছেন কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহ। এক বার নয়, অন্তত বার দশেক। বাটলার ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি তুলেছেন। সন্ত্রাসের তকমা নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন রাহুল গাঁধী। শিবলি-র অতিথিশালায় রাত কাটিয়ে জানান দিয়েছেন, “তোমাদের পাশে আছি।” অথচ রাহুল-দিগ্বিজয়ের অবস্থান নিয়ে দিল্লিতে প্রশ্ন উঠলেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম প্রতিবার জানিয়েছেন, ‘এনকাউন্টার ভুয়ো নয়। সন্ত্রাসবাদীরা সকলেই আজমগড়ের।’ তা হলে কাকে বিশ্বাস করবেন মির্জা মেহফুস-রা?
মন পাওয়ার চেষ্টায় অবশ্য পিছিয়ে নেই মুলায়ম-মায়াবতীও। বাটলা নিয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন তাঁরাও। এমনকী উত্তরপ্রদেশে প্রার্থী ঘোষণা হতে না হতেই তাতে সুর মিলিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। আর বিজেপি-র অভিযোগ, সংখ্যালঘু ভোট পেতে এ হল নগ্ন তোষণনীতি। আসলে এরাই আজমগড়ের সর্বনাশের মূলে!
কার কাছে যাবে আজমগড়? নাকি এদের সকলের উপর থেকেই তার বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে? সদ্য গজিয়ে ওঠা উলেমা পরিষদের মিছিলে নইলে এত ভিড় হবে কেন?
আজমগড় বোধহয় হতাশ। ভোটে কেউ একটা জিতবে। তাতে দিন বদলের বিশেষ আশা দেখতে পাচ্ছে না সে। উমের নাদভি-র বরং আক্ষেপ, “আর ক’দিন পর মানুষ হয়তো এ-ও ভুলে যাবে, আজমগড়ের আখ পূর্বাঞ্চলের সেরা। দারুণ মিষ্টি। যেমন মিষ্টি এখানকার উর্দু লব্জ।” শুধু আবু সালেম তো নন! আজমগড়ের ভূমিপুত্র মানে রাহুল সাংকৃত্যায়ন আর কাইফি আজমিও। |