ফুলকুসমা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চালু হয়নি অন্তর্বিভাগ |
প্রথমে ছিল ছ’টি শয্যা। তার পরেও আরও দশটি শয্যা বাড়ায় স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু অন্তর্বিভাগ চালু হয়নি। বাঁকুড়ার রাইপুর ব্লকের ফুলকুসমা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এই অবস্থা। গত দু’দশকেও এখানে অর্ন্তবিভাগ চালু করতে পারেনি স্বাস্থ্য দফতর।
মাওবাদী অধ্যুষিত এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আশপাশের প্রায় ৩৫টি গ্রামের কমবেশি ৪০ হাজার মানুষ চিকিৎসা করাতে আসেন। প্রায় ২২ বছর আগে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি তৈরি হয়। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রথমে ছয় শয্যাবিশিষ্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে বহির্বিভাগ চালু হয়েছিল। দু’ বছর আগে আরও দশটি শয্যা দেওয়া হয়। কিন্তু অন্তর্বিভাগ চালু হয়নি আজও।
কেন?
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একমাত্র চিকিৎসক সুরজিৎ বাস্কের কথায়, “শুনেছি অর্ন্তবিভাগ চালু হবে। তবে এখনও হয়নি। কেন হয়নি বলতে পারব না।” জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক জগন্নাথ দিন্দা বলেন, “সর্বত্র চিকিৎসক, কর্মীর সংখ্যা কম। শীঘ্রই ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্তর্বিভাগ পরিষেবা চালু করা এবং কর্মী নিয়োগ করা হবে।” তিনি জানান, কিছু অসুবিধার জন্যেই সেখানে অন্তর্বিভাগ চালু করা যায়নি। তবে গর্ভবতী মহিলাদের প্রসবের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরে নির্ভরশীল রাইপুর ব্লকের শবরচাকা, নামোসোল রসপাল, ঠাকুরবাড়ি, মণ্ডলডিহা, দুঁধ্যা, বক্সি, চামটাবাদ-সহ আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র নামেই! |
বহির্বিভাগে শুধুমাত্র সর্দি-কাশি বা জ্বরের চিকিৎসা করা হয়। গুরুতর কিছু হলে রোগীদের নিয়ে যেতে হয় অন্তত ১৬ কিলোমিটার দূরের রাইপুর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা ৪২ কিলোমিটার দূরের খাতড়া মহকুমা হাসপাতালে। রাতে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে চিকিৎসা পরিষেবা না মেলায় রোগী-মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু তারপরেও এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্তর্বিভাগ পরিষেবা চালু হয়নি। এলাকাবাসীর দাবি, জেলা স্বাস্থ্য দফতরে একাধিকবার জানানো হয়েছে। কিন্তু অন্তর্বিভাগ চালু হয়নি।
সম্প্রতি ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, বহির্বিভাগে বেশ কয়েক জন রোগী চিকিৎসা করাতে এসেছেন। শুশুনিয়া গ্রামের বীরবল মণ্ডল, পাটমোড়া গ্রামের বাসিন্দা গণেশ রজক, পুরু দাসরা সর্দি-জ্বর নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেছিলেন। তাঁরা জানালেন, সকাল ৯টায় বহির্বিভাগ খোলা হয়। দুপুর তিনটে পর্যন্ত রোগী দেখা হয়। তাঁদের ক্ষোভ, “বহির্বিভাগে শুধু জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল, অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট আর পেটখারাপ হলে মেট্রোজিল এবং ওআরএস পাউডার দেওয়া হয়। একটু বাড়াবাড়ি হলে এখানে আর চিকিৎসা করা হয় না। রাইপুর বা খাতড়ায় স্থানান্তর করে দেয়।” তাঁদের আক্ষেপ, “অন্তর্বিভাগ চালু হলে হুট করতেই চিকিৎসক অন্যত্র স্থানান্তর করতেন না।”
এত দিন পরেও অর্ন্তবিভাগ পরিষেবা চালু না হওয়ায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও। ফুলকুসমা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান আরএসপি-র দুর্গা দুলের ক্ষোভ, “শয্যা পাঠিয়ে স্বাস্থ্য দফতর দায়িত্ব সেরেছে। অন্তর্বিভাগ পরিষেবা চালু ‘এই হবে-এই হবে’ বলে দীর্ঘ দিন ধরে শুনে আসছি। চালু না হওয়ার জন্য আগের ছয়টি শয্যা নষ্ট হয়েছে। পরিষেবা নিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের কাছে বারবার অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয়নি।” প্রধানের অভিযোগ, “অন্তর্বিভাগ চালু না হওয়ায় এলাকার মানুষ রাতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন। চোখের সামনে বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর ঘটনা দেখতে হয় আত্মীয়-পরিজনদের।”
এত দিনেও অন্তর্বিভাগ পরিষেবা চালু না হওয়ার জন্য অবশ্য পূর্বতন বাম সরকারকে দুষছেন তৃণমূলের রাইপুর ব্লক সভাপতি জগবন্ধু মাহাতো। তাঁর অভিযোগ, “ফুলকুসমা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্তর্বিভাগ চালু না হওয়ার জন্য দায়ি পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার। আমরা অন্তর্বিভাগ চালু করবার জন্য স্বাস্থ্য দফতরের কাছে দাবি জানিয়েছি।” সিপিএমের রাইপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক শ্যামসুন্দর সিংহ মহাপাত্র অবশ্য দাবি করেন, “স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে কোয়ার্টার সবই হয়েছে আমাদের বাম জমানায়। অন্তর্বিভাগ চালু করার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়। কিন্তু পরিকাঠামোগত অসুবিধার জন্য তা চালু করা যায়নি বলে স্বাস্থ্য দফতর জানিয়েছিল।”
কর্মীর অভাবও রয়েছে। এখানে এক জন চিকিৎসক, এর জন ফার্মাসিস্ট রয়েছেন। আছেন চার জন নার্স। কিন্তু নেই কোনও চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। নেই সাফাই কর্মীও। ১০টি কোয়ার্টার রয়েছে। কর্মীর অভাবে পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে বলে ক্ষোভ চিকিৎসক থেকে স্থানীয় বাসিন্দা- সকলেরই। চিকিৎসক সুরজিৎ বাস্কের আক্ষেপ, “মাস খানেক আগে এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ও এক সাফাই কর্মী অবসর নিয়েছেন। কিন্তু ওই দু’টি পদে নতুন করে নিয়োগ হয়নি। ফলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দৈনন্দিন কাজকর্ম চালাতে গিয়ে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। মাঝেমধ্যে আমাকে স্বাস্থ্য শিবিরে যেতে হয়।” ফার্মাসিস্ট প্রসন্ন মণ্ডল বলেন, “রোগীর চাপ রয়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় কর্মী নেই। তবু আমরা সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। সব ওষুধ এখানে মজুতও নেই।” সমস্যার কাটিয়ে আপাতত অন্তর্বিভাগ চালুর প্রতীক্ষায় ফুলকুসমা-সহ আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা। |