নার্স বাড়ন্ত, মায়েদেরই তালিম দিয়ে শিশুর পরিচর্যা |
সোমা মুখোপাধ্যায় • কলকাতা |
গোলাপি গাউন পরে, টান করে চুল বেঁধে, সাবানে হাত ধুয়ে ওঁরা দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক-একটা শয্যার পাশে। চোখে অতন্দ্র সতর্কতা।
রেডিয়্যান্ট ওয়ার্মারের নীচে পর পর শিশুরা শুয়ে। কেউ হয়তো একটু কেঁদে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে পাশের গোলাপি গাউন ঝুঁকে পড়লেন তার দিকে। দেখে নিলেন, ড্রিপ ঠিকঠাক চলছে তো? গায়ে হাত রেখে বুঝতে চাইলেন, উত্তাপ অতিরিক্ত বেড়ে গেল কি না। তেমন বুঝলে সঙ্গে সঙ্গে ডেকে আনলেন ডাক্তারকে।
যে রাজ্যে আড়াই হাজারেরও বেশি নার্সের পদ ফাঁকা, সেখানে এ ভাবে শয্যাপিছু ২৪ ঘণ্টার সেবিকা রাখা সম্ভব হচ্ছে কী ভাবে? আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিওনেটাল ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটের ছবিটা দেখার পরে সর্বাগ্রে এই প্রশ্নটাই জাগে। প্রশ্নে যতটা বিস্ময়, উত্তরে চমক আরও বেশি। কারণ ডাক্তারেরা জানাচ্ছেন, গোলাপি গাউনের ওই ‘সেবিকা’রা আসলে শিশুদের মা! নার্সের অভাবে পরিষেবায় যাতে ঘাটতি না-হয়, সে জন্য মায়েদের ন্যূনতম প্রশিক্ষণ দিয়ে সন্তানের পরিচর্যায় লাগানো হচ্ছে। তত্ত্বাবধানে থাকছেন ওয়ার্ডের ডাক্তারেরা। কিন্তু এটা কতটা নিরাপদ? |
মা-ই সেবিকা। আর জি করে। ছবি: সুদীপ আচার্য |
শিশুমৃত্যু রোধে রাজ্যের গড়া টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান, তথা শিশু-চিকিৎসক ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সন্তানের জন্য মায়ের চেয়ে বড় নার্স পৃথিবীতে আর কেউ হতে পারেন না। চ্যানেল করা, ইঞ্জেকশন দেওয়া ইত্যাদি পেশাদার নার্সরা করছেন। কিন্তু বাচ্চার সব সময়ের দেখাশোনাটা মায়েরা হয়তো বেশিই পারবেন।” বস্তুত এতে ওখানে শিশু-মৃত্যুর হারও অনেকটা কমানো গিয়েছে বলে চিকিৎসকদের দাবি। যার প্রেক্ষিতে টাস্ক ফোর্সের সদস্য, জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের রাজ্য অধিকর্তা দিলীপ ঘোষের মন্তব্য, “হা-হুতাশ না-করে বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধান সব সময়েই কাম্য।”
রাজ্যে সর্বাধিক প্রসব হয় আর জি করে, বছরে ১৯ হাজারের বেশি। সেই তুলনায় শিশু বিভাগে নার্স খুবই কম। এখানে রুগ্ণ নবজাতকদের জন্য দু’টো আলাদা ওয়াড ইনবর্ন (আর জি করেই জন্মানো শিশুদের জন্য) ও আউটবর্ন (অন্যদের জন্য)। আউটবর্নে শয্যা ১০টি। চিকিৎসকদের বক্তব্য, দুই ওয়ার্ড মিলিয়ে নার্স সাকুল্যে ১৬ জন, যেখানে দরকার অন্তত ৪৭ জন। এবং এই ঘাটতি মেটাতেই নার্স হিসেবে মায়েদের রাখা হচ্ছে আউটবর্ন ওয়ার্ডে। আর জি করের শিশু বিভাগের প্রধান চিকিৎসক শিবার্জুন ঘোষ বলছেন, “রুগ্ণ সদ্যোজাতের পরিচর্যায় নার্স-রোগীর অনুপাত ১:১ হওয়া উচিত, এখানে যা অসম্ভব। মায়েদের পেয়ে আমরা সেটাই করতে পারছি।” এতে অন্য সুবিধাও হচ্ছে। কী রকম?
আগে দূর থেকে আসা মায়েরা গাছতলায় রাত কাটাতেন। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। সেই অবস্থায় স্তন্যপান করানোয় বাচ্চাও অসুস্থ হয়ে পড়ত। ওয়ার্ডের ইনচার্জ অভিজিৎ দত্ত বলেন, “রুগ্ণ শিশুর কাছে মায়ের দুধও তো ওষুধ। এখন দরকার পড়লেই তা দিতে পারছি।” হাসপাতালে মায়েদের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। ওয়ার্ডের পাশে একটা ঘরে দু’টো বিছানা। মায়েরা সেখানে বিশ্রাম নেন। তখন তাঁদের বাচ্চার দেখভাল করেন অন্য মায়েরা।
প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা মায়েরা এ হেন গুরুদায়িত্ব সামলাচ্ছেন কী ভাবে? শিবার্জুনবাবু জানালেন, ওঁদের প্রাথমিক তালিম দেওয়া হচ্ছে। ওয়ার্মার ঠিক চলছে কি না, বাচ্চার শরীর অতিরিক্ত গরম হচ্ছে কি না, ড্রিপে চ্যানেলের জায়গা ফুলছে কি না, বাচ্চা মলমূত্র ত্যাগ করেছে কি না ইত্যাদি খেয়াল রাখার তালিম। বলা হয়েছে, এমন কিছু হলে তৎক্ষণাৎ নার্স বা ডাক্তারকে ডাকতে। শিবার্জুনবাবুর কথায়, “এই কাজে পারদর্শিতার চেয়েও বেশি দরকার মমতা। সেটা মায়ের চেয়ে বেশি কার থাকবে?”
তাই উত্তর ২৪ পরগনার ন্যাজাটের সুলতা বিশ্বাস কিংবা ডানকুনির উমা দেবনাথরা গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে ওয়ার্ডে ঘোরাফেরা করছেন। উমার ছেলের ওজন আটশো গ্রাম। তিনি বলছেন, “নিজের বাচ্চার যত্ন নিজে করতে পারছি, এর চেয়ে বড় শান্তি আর কী?” |