নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
পুনর্বাসনের দাবিটা এসেছিল মগরাহাটের চোলাই কারবারিদের কাছ থেকে। রীতিমতো কমিটি গড়ে তারা পোস্টার সেঁটেছিল, ‘মাওবাদী বা কেএলও জঙ্গিদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার যদি আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করতে পারে, তবে চোলাই কারবারিরা তা পাবে না কেন?’
চোলাই কারবারিদের সেই দাবিই মেনে নেওয়ার দিকে শুক্রবার কার্যত এক পা এগোল রাজ্য সরকার। টাউন হলে মন্ত্রী-আমলাদের সঙ্গে বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “ওঁরা যাতে অন্য কোনও ব্যবসা করতে পারেন, সেই ব্যাপারে আমরা একটা পরিকল্পনা করছি। ওঁদের সামাজিক সুরক্ষার জন্যই এই পরিকল্পনা।”
চোলাই কারবারিদের দাবি মেনে তাদের সুরক্ষার জন্য বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করার কথা ঘোষণা করা হলেও ওই বেআইনি কারবার স্থায়ী ভাবে বন্ধ করার ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী নতুন কোনও পরিকল্পনার কথা জানাতে পারেননি। তিনি এ দিন বলেন, “চোলাই কারবারিদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। এই ব্যাপারে আইনের কিছু পরিমার্জন দরকার।”
কিন্তু এ ভাবে কি চোলাই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব?
আবগারি দফতরের কর্তারা এবং অর্থনীতিবিদদের একাংশ বারে বারেই বলছেন, শুধু কড়া আইন করেই চোলাই মদের এই বিশাল কারবার স্থায়ী ভাবে নির্মূল করা সম্ভব নয়। কারণ, রাজ্যের লক্ষ লক্ষ দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষের কাছে বেআইনি চোলাইয়ের কোনও বিকল্প নেই। রাজ্যে সরকার অনুমোদিত দেশি মদের দোকানের সংখ্যা হাতে গোনা। তাই এর উৎপাদনও সামান্য। চাহিদা ও জোগানের এই বিপুল অসাম্যই গরিবদের বেআইনি ‘বিষাক্ত ’ চোলাইয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। |
এ দিনের বৈঠকে দেশি মদের জোগান বাড়িয়ে চোলাইয়ের মতো ক্ষতিকর পানীয়ের মোকাবিলা করারও কোনও প্রস্তাব ওঠেনি বলে সরকারি সূত্রের খবর। চোলাই রুখতে দেশি মদের লাইসেন্স দেওয়া শুরু করা হবে কি না, বৈঠকের পরে তা জানতে চাইলে মুখ্যমন্ত্রী মহাকরণে বলেন, “এই বিষয়ে কোনও আলোচনা হয়নি।”
তা হলে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা হলেই কি চোলাই কারবার বন্ধ হবে?
অর্থ দফতরের এক কর্তা বলেন, “এখনকার চোলাই কারবারিদের বিকল্প রোজগারের ব্যবস্থা করা হলেই সেই জায়গায় ফের নতুন কারবারি গজিয়ে উঠবে। কারণ, চোলাইয়ের চাহিদা থাকায় অর্থনীতির সাধারণ নিয়মেই ওই কারবারে বেআইনি বিনিয়োগও আসবে। তাই এ ভাবে মূল সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।”
প্রশ্ন আরও আছে। কী ভাবে চোলাই কারবারিদের চিহ্নিত করে তাদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা হবে?
এ ব্যাপারেও ধন্দ রয়েছে অর্থ দফতরের কর্তাদের মধ্যে। দফতরের এক কর্তা বলেন, “এর পরে তো যে-কোনও বেআইনি কারবার বন্ধ করতে গেলেই সেই কারবারিদের জন্য সরকারি কোষাগার থেকে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে!”
সততা-অসততার দিক থেকে নতুন প্রশ্ন উঠতে পারে বলে মনে করছেন ওই কর্তারা। তাঁরা বলছেন, “যে-সব গরিব মানুষ শত প্রলোভনেও কোনও বেআইনি কারবারে নিজেদের জড়ালেন না, তাঁরাও তো প্রশ্ন তুলতে পারেন, সৎ থেকে তাঁদের লাভটা হল কী?”
আবগারি দফতরের বক্তব্য, ২০০৯ সালে বন্দর এলাকায় বিষমদে ২৬ জনের মৃত্যুর পরে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারও চোলাই বন্ধের জন্য কড়া আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিল। তখনও রাজ্য জুড়ে চোলাই মদের বহু ভাটি ভাঙা হয়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই ফের তা তৈরি হয়ে যায়। পরবর্তী কালে চোলাই মদ বন্ধে একটি নিগম তৈরি করে দেশি মদের উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা করেছিলেন রাজ্যের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত।
তাঁর পরিকল্পনা ছিল, চোলাই মদের ভাটিগুলিতে কর্মরত মানুষকেই নিগমের আওতায় এনে মদ তৈরির কাজে লাগানো হবে। কিন্তু নির্বাচন এসে যাওয়ায় সেই পরিকল্পনা ধামাচাপা পড়ে যায়।
নতুন সরকারও এই নিয়ে আর কোনও রকম উচ্চবাচ্য করেনি। চলতি মাসে মগরাহাটে বিষমদে ১৭২ জনের মৃত্যুর পরেই বিষয়টি নিয়ে ফের নাড়াচাড়া শুরু হয়। ফের অভিযান শুরু হয় বেআইনি চোলাইয়ের বিরুদ্ধে। রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এ দিন বৈঠকে জানান, গত এক সপ্তাহেই রাজ্যে ৪৮২২১ লিটার বেআইনি মদ ধরা হয়েছে।
রাজ্য সরকার অবশ্য কড়া আইন তৈরির সঙ্গে সঙ্গে আমজনতার সচেতনতা বাড়াতে প্রচার-অভিযানও চালাতে চায়। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “চোলাই মদ এবং অনলাইন লোটো এ দু’টোই সামাজিক ব্যাধি।” আগামী ৩০ ডিসেম্বর চোলাই মদের বিরুদ্ধে পদযাত্রাও করবেন মুখ্যমন্ত্রী। কলেজ স্কোয়ার থেকে ময়দানে গাঁধী-মূর্তির পাদদেশ পর্যন্ত হবে সেই পদযাত্রা। |