নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
প্রথম দু’দফার সৌজন্যের পরিবেশটা মুছে গেল তৃতীয় বারের শেষে! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় বিধানসভার তৃতীয় অধিবেশনে এসে চিড় স্পষ্ট হয়ে উঠল সরকার ও বিরোধীদের ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ’ সম্পর্কে। আগামী অধিবেশনগুলি যে আরও ‘উত্তপ্ত’ হতে চলেছে, তার ইঙ্গিতও দিয়ে রাখল বিরোধী শিবির।
মগরাহাটে চোলাই মদে বিষ ও নোদাখালিতে পানীয় জলে বিষ মেশানোর ‘গুজব’-এর জন্য সিপিএমই দায়ী এই বক্তব্যে অনড়ই রয়েছে সরকার পক্ষ। তার সঙ্গেই শুক্রবার যোগ হয়েছে আমরি-কাণ্ডেও সিপিএম ‘প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে’ দোষী বলে সরকারের অভিযোগ। অথচ এই আমরি-তে নজিরবিহীন ট্র্যাজেডির পরে শাসক ও বিরোধী শিবিরের ‘বেনজির ঐক্যের ছবি’ দেখেছিল রাজ্য রাজনীতি। কিন্তু দোষারোপের পালা যে ঘটনাপ্রবাহকে ফের ‘তিক্ততা’র দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, তারই স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে এ দিন শেষ হল বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশন। অধিবেশনের শেষে বার্ষিক পুষ্প প্রদর্শনীর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েও উপস্থিত হননি বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র।
ডেপুটি স্পিকার সোনালি গুহের পাশেই আসন রাখা হয়েছিল বিরোধী দলনেতার জন্য। কিন্তু সিপিএমের মুর্শিদাবাদ জেলা সম্মেলনের জন্য অধিবেশন শেষ হতেই দ্রুত বিধানসভা ছাড়েন সূর্যবাবু। বলে যান, “ফুল, শিশু এ সব খুব পবিত্র বিষয়। এতে বিষ ঢুকুক, আমরা চাই না!” কী জন্য সূর্যবাবুর ওই বক্তব্য, সেই ইঙ্গিতও খুব স্পষ্ট সিপিএম-ই মদ, জল থেকে মিড ডে মিলে বিষ মেশাতে চাইছে বলে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য। বিরোধী দলনেতার আরও চাঁছাছোলা মন্তব্য, “বিষ রয়েছে ওঁদের জিভে (পয়জন ইজ ইন দ্য টাং)! বিষোদ্গার করছেন, তাতেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছে। কখনও দেখিনি যে, সরকারই দায়িত্ব নিয়ে গুজব প্রচার করছে!” |
বিধানসভায় শেষ দিনের অধিবেশন শুরুই হয়েছিল হইচইয়ের মধ্যে দিয়ে। মমতা সরকারের জমানায় এমন দৃশ্য এই প্রথম। পোস্টার-প্ল্যাকার্ড নিয়ে সভায় ঢুকেছিলেন বিরোধীরা। তাঁদের দাবি, মুখ্যমন্ত্রী এবং জনস্বাস্থ্য কারিগরি মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বৃহস্পতিবারের মন্তব্য ‘প্রত্যাহার, নয়তো প্রমাণ’ করতে হবে। সভায় ঢুকেই সিপিএম বিধায়ক আনিসুর রহমান ওই মন্তব্য প্রত্যাহার করার দাবি তোলেন। স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় তা গ্রাহ্য না করায় বিরোধীরা বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। তার মধ্যেই প্রশ্নোত্তর পর্ব চালিয়ে যান স্পিকার। মাঝে সরকার পক্ষের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় এক বার মন্তব্য করেন, “সরকারে থাকতে যারা তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা সম্পর্কে কুৎসিত মন্তব্য করত, তাদের মুখে এখন ‘গণতন্ত্রে’র কথা মানায় না।” তত ক্ষণে সভাকক্ষে এসে পড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা স্বয়ং।
ধূপগুড়িতে এক আলু চাষির ‘আত্মহত্যা’ নিয়ে মুলতুবি প্রস্তাব আনতে চেয়েছিলেন বিরোধীরা। স্পিকার প্রস্তাবটি পড়তে দিলেও আলোচনার অনুমতি দেননি। প্রতিবাদে কক্ষত্যাগ করেন বাম বিধায়করা। বাইরে গিয়ে আনিসুর স্পিকারের ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়েই প্রশ্ন তোলেন। আর মন্ত্রী সুব্রতবাবু তাঁদের বক্তব্যে অনড় থেকেই বলেন, “দলীয় সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, যারা বিশেষ বিশেষ চায়ের দোকান থেকে জলে বিষের গুজব ছড়াতে শুরু করেছিল, তারা সিপিএমের কমরেড। প্রমাণ তো রাতারাতি করতে পারব না! যেমন যেমন তথ্য আসবে, জানিয়ে দেব। আবার বলছি, দলীয় সূত্রে খবর পেয়েছি। তবে বিধানসভায় এ সব তথ্য দিতে আমরা বাধ্য নই।” সিআইডি-কে ‘আনুষ্ঠানিক ভাবে’ ভার দেওয়া না হলেও ওই ঘটনায় তারা ‘রুটিন তদন্ত’ চালাচ্ছে বলে সুব্রতবাবু জানান। সেই সঙ্গেই তাঁর মন্তব্য, “গুজব ছড়িয়ে সিপিএম বিভীষিকা তৈরির চেষ্টা করছে! আমরিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে ওরা যুক্ত থেকেছে। বিষ মদে যুক্ত থেকেও এখন নাটক মঞ্চস্থ করছে। ছ’মাসেই ওদের ধৈর্যচ্যুতি হচ্ছে!”
প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর জমানায় আমরি-র অন্যতম কর্ণধার এস কে তোদির উত্থান এবং আলিমুদ্দিনের সঙ্গে আমরি কর্তৃপক্ষের ‘ঘনিষ্ঠতা’র বিষয়টি ইতিমধ্যেই বহুচর্চিত। সুব্রতবাবু এ দিন বলেন, “আমরি-কাণ্ডেও সিপিএম আছে। এটা একটা বড় ষড়যন্ত্র। এর বেশি কিছু এখনই বলব না।” বিষ মদ-কাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত খোঁড়া বাদশার দুই স্ত্রীর মধ্যে বিবাদের জেরেই বিষাক্ত চোলাইয়ে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র বৃহস্পতিবার প্রথমে যা বলেছিলেন (পরে তা থেকে সরে আসেন), তাকেও গুরুত্ব দিতে চাননি সুব্রতবাবু। বরং, বিরোধীদের আক্রমণ করে তাঁর পাল্টা বক্তব্য, “সিপিএম তথা বামফ্রন্ট গত ৩৫ বছরে রাজ্যে নৈরাজ্য তৈরি করেছে। এখন বিধানসভার ভিতরে-বাইরেও সেই নৈরাজ্য তৈরির চেষ্টা করছে! মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এই রাজ্যকে আমরা উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে বিরোধীদের সহযোগিতা চেয়েছি। তা সত্ত্বেও সংসদীয় ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছেন ওঁরা! আমরা সেই চ্যালেঞ্জ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছি ও করব।”
সরকারের এমন ‘আক্রমণাত্মক’ অবস্থানের জবাবে পাল্টা ‘আক্রমণাত্মক’ হয়েছে বিরোধীরাও। জলে বিষের গুজব নিয়ে প্রথমে জলপাইগুড়িতে এবং পরে কলকাতায় ফিরে আলিমুদ্দিনে এক প্রশ্নের জবাবে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এ দিন বলেন, “সরকারের কাছে যদি প্রমাণ থাকে, তবে সেটা সংবাদমাধ্যমকে না বলে মামলা রুজু করছে না কেন? সরকারের হাতেই তো পুলিশ রয়েছে! প্রয়োজনে গ্রেফতার করুক। সেটা হলেই তো প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না!” আর বিরোধী দলনেতা বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী যে ভাষায় এবং যে ভঙ্গিতে কথা বলছেন, নিন্দা করার ভাষা নেই। আমাদের বৃহত্তর প্রতিবাদের পথে যেতে হবে। গত দু’টি অধিবেশনে ওঁরা সৌজন্যের সুযোগ নিয়েছেন। রাজনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের উপরে আক্রমণ হলে আমরাও চুপ করে থাকব না!”
সরকার বিরোধী পক্ষের সম্পর্ক যে দিকে মোড় নিচ্ছে, তার ‘উপযুক্ত’ বর্ণনা ধরা পড়ল ডেপুটি স্পিকার সোনালিদেবীর কথায়। বিরোধী শিবিরে থাকাকালীন ‘হল্লা ব্রিগেড’-এর অন্যতম সদস্য হিসাবে পরিচিত ছিলেন তিনি। এ দিন অধিবেশন শেষে আনুষ্ঠানিক ধন্যবাদ জানানোর সময় বিরোধীদের বিক্ষোভ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হল। আমার কায়দা আমাকেই দেখালেন!” |