মাসুল না-বাড়ালে গরমে
আশঙ্কা লম্বা লোডশেডিং
গামী গ্রীষ্মে পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক লোডশেডিং হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। রাজ্যের বিদ্যুৎ-কর্তাদের একাংশ মনে করছেন, ঘোর গরমে দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পর্যন্তও বিদ্যুৎহীন অবস্থায় কাটাতে হতে পারে রাজ্যবাসীকে।
কেন এই অশনি সঙ্কেত?
বিদ্যুৎ দফতর সূত্রের খবর: চলতি অর্থবর্ষে (২০১১-১২) এখনও মাসুল বাড়াতে না-পারায় রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার ভাঁড়ার কার্যত শূন্য হয়ে গিয়েছে। ফলে গ্রীষ্মের বাড়তি চাহিদা সামলাতে বাজার থেকে বিদ্যুৎ কেনার মতো টাকা হাতে না-ও থাকতে পারে। অন্য দিকে রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম যে গ্রীষ্মে বাড়তি উৎপাদন করে চাহিদা মেটাবে, সে আশাও ক্ষীণ। কারণ, বণ্টন সংস্থা কত দরে নিগমের বিদ্যুৎ কিনে কত দামে তা গ্রাহকদের বেচবে, তা স্থির করে রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন। অথচ বণ্টন সংস্থা কমিশনের কাছে মাসুলবৃদ্ধির আবেদন করতে পারেনি। ফলে নিগমকেও চড়া দরে কেনা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করে তা কম দরে বেচে লোকসান করতে হচ্ছে। এর জেরে নিগমের ভাঁড়ারেও হাঁড়ির হাল। তাদের ধারে কয়লা কিনতে হচ্ছে কোল ইন্ডিয়ার কাছ থেকে।
এই সব মিলিয়ে রাজ্যের বিদ্যুৎ-পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে লোডশেডিংয়ের দাপট বাড়তে পারে বলেই বিদ্যুৎ-কর্তাদের অনেকে মনে করছেন। শুধু তা-ই নয়, এ কথা রাজ্য সরকারকে জানিয়েও দিয়েছেন বণ্টন কর্তৃপক্ষ। বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত অবশ্য এখনই তেমন আশঙ্কার কারণ দেখছেন না। তিনি জানিয়েছেন, গ্রীষ্মের চাহিদা মেটানোর যাবতীয় ব্যবস্থা এখন থেকেই নিচ্ছেন তাঁরা, যার ফল ঠিক সময়ে মিলবে। মণীশবাবুর দাবি, “কোনও সংস্থার আর্থিক অবস্থা কখনও-সখনও খারাপ হতে পারে। এতে ভয়ের কিছু নেই। মানুষ বিদ্যুৎ পাবে।”
কিন্তু ঘটনা হল, মাসুল না-বাড়ালে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি যে ক্রমশ খারাপের দিকে যাবে, গত ক’মাস ধরে বিদ্যুৎ-কর্তারা তা বারবার সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন সময়ে এই আবেদন নিয়ে তাঁরা গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও। কিন্তু মানুষের উপরে ‘বোঝা’ চাপবে বলে মুখ্যমন্ত্রী তাতে সায় দেননি।
অর্থাৎ, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সরকার রাজি নয় বলে এ বছর এখনও পর্যন্ত বণ্টন সংস্থা কমিশনের কাছে মাসুলবৃদ্ধির আবেদন করতে পারেনি। গত অর্থবর্ষে কিন্তু এই সমস্যা ছিল না। সেই সঙ্গে সংস্থাও ভিন রাজ্যের বিভিন্ন সংস্থাকে খেপে-খেপে বিদ্যুৎ দিয়ে বিনিময়ে গ্রীষ্মকালে সমপরিমাণ বিদ্যুৎ ফেরত পাওয়ার চুক্তি করে রেখেছিল। তাই গত গ্রীষ্মে লোডশেডিং তুলনায় কম ছিল। চলতি শীতেও লোডশেডিং করে ভিন রাজ্যে বিদ্যুৎ দেওয়ার চেষ্টা চলছে, যাতে গরমে তা ফেরত পাওয়া যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিছুটা বাদ সেধেছে উৎপাদনের সমস্যা। এই সময়ে নিগমের যেখানে ৩১০০-৩২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন করার কথা, সেখানে কয়লার অভাব ও যান্ত্রিক ত্রুটির দরুণ গড়পড়তা ৫০০ মেগাওয়াট কম উৎপাদন হচ্ছে।
কর্তাদের অনেকেরই আশঙ্কা, উৎপাদনের এই সঙ্কট গ্রীষ্মে আরও প্রকট হবে। ওঁদের এক জন জানিয়েছেন, কয়লার দাম বাবদ কয়লা-সংস্থাগুলোর কাছে নিগমের দেনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। অঙ্কটা প্রতি দিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ওই কর্তার দাবি, গ্রীষ্মে বাড়তি উৎপাদনের জন্য যখন বাড়তি কয়লা লাগবে, তখন কয়লা সংস্থাগুলোও বকেয়া মেটাতে চাপ দেবে। না-পেলে কয়লা দিতে চাইবে না। ফলে মার খাবে উৎপাদন। আগামী গ্রীষ্মে রাজ্যে বিদ্যুতের চাহিদা-চিত্রটি কী রকম হতে পারে?
বণ্টন-কর্তৃপক্ষ হিসেব কষে দেখেছেন, আগামী বছরের প্রখর গরমে বণ্টন-এলাকায় প্রতি দিন বিদ্যুতের চাহিদা থাকবে ৪৮০০ মেগাওয়াটের মতো। পাশাপাশি সিইএসসি-কে দিতে হবে ৫০০-৬০০ মেগাওয়াট। সব মিলিয়ে প্রতি দিন চাহিদা দাঁড়াবে কম-বেশি ৫৪০০ মেগাওয়াট। জোগানের ছবিটা কেমন?
দফতরের তথ্য: বণ্টন সংস্থার নিজস্ব উৎপাদন বলতে পুরুলিয়া জল-বিদ্যুৎ প্রকল্পের ৯০০ মেগাওয়াট। এর বাইরে নিগম থেকে রোজ পাওয়া যাচ্ছে ২৬০০-২৭০০ মেগাওয়াট। ডিভিসি-ডিপিএলের মতো বিভিন্ন উৎপাদকের কাছ থেকে দিনে কম-বেশি ৮০০ মেগাওয়াট কেনার সুযোগ রয়েছে। তিনশো মেগাওয়াটের মতো মিলবে সঞ্চয় ভাণ্ডার থেকে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে গ্রীষ্মকালে রোজ ৪,৭০০ মেগাওয়াটের মতো সরবরাহের বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার হাতে থাকতে পারে। তাতেও অন্তত দৈনিক সাতশো মেগাওয়াট ঘাটতির আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
এই ঘাটতির কতটুকু মেটানো যাবে, বিদ্যুৎ-কর্তারা সে সম্পর্কে কোনও ইঙ্গিত এখনই দিতে পারছেন না। বণ্টন সংস্থার চেয়ারম্যান রাজেশ পাণ্ডে অবশ্য বলছেন, “গ্রীষ্মের চাহিদা মেটাতে বাজার থেকে বিদ্যুৎ কেনার জন্য দরপত্র ছাড়া হয়েছে। প্রয়োজনমতো তখন বিদ্যুৎ কেনা হবে।” যদিও এক কর্তার মতে, গ্রীষ্মে গ্রিডের বিদ্যুৎ কিনে লোডশেডিং সামলানো যায় না। তিনি বলছেন, “ওই সময় দামের ঠিক থাকে না। চাহিদা বাড়তে থাকলে বিদ্যুতের দরও চড়চড় করে বাড়ে। ন্যূনতম দাম হয়ে যায় ইউনিটে প্রায় সাড়ে ছ’টাকা। এ দিকে আমরা গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বেচছি ৪ টাকা ২৭ পয়সায়!”
এখানেই থেকে যাচ্ছে সঙ্কটের শিকড়টা। কর্তাদের একাংশের বক্তব্য: মাসুল না-বাড়িয়ে গ্রীষ্মে যদি ওই দামেই বিদ্যুৎ বেচতে হয়, তা হলে ইউনিটপিছু বণ্টন সংস্থার লোকসান হবে দু’টাকার বেশি। তাতে লোকসানের বহর আরও বাড়বে। বাড়বে বিদ্যুৎ কেনার ক্ষমতাও। বেশ কিছু বিদ্যুৎ-কর্তা তাঁদের ‘অভিজ্ঞতা’ থেকে জানিয়েছেন, বিদ্যুতের দাম ৩৫-৪০ পয়সা বাড়লে মানুষ যত না অসন্তুষ্ট হয়, তার চেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে লোডশেডিং হলে। রাজ্যকে এই ‘সারবাক্যটাই’ বুঝিয়ে ওঠা যাচ্ছে না বলে আক্ষেপও করেছেন ওঁরা।
বণ্টন সংস্থা-সূত্রের খবর: চলতি অর্থবর্ষে মাসুল বাড়াতে না-পারলে সংস্থার কমপক্ষে ২২০০ কোটি টাকা লোকসান হবে। ৫০০ কোটির মতো ক্ষতি হবে নিগমের। অথচ গত অর্থবর্ষে (২০১০-১১) দু’টো সংস্থাই মুনাফা করেছিল। বণ্টন সংস্থা একাই লাভ করেছিল প্রায় একশো কোটি টাকা!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.