বহু চর্চিত পশ্চিমবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় আইন (সংশোধনী) বিল শুক্রবার বিধানসভায় পাশ হল। রাজ্য সরকারের দাবি, দলতন্ত্রমুক্ত, স্বচ্ছ এবং উৎকর্ষমুখী শিক্ষা-প্রশাসন গড়তে খুবই সহায়ক হবে এই বিল। রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, সরকার ওই বিলে ২৬টি সংশোধনী আনে। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু প্রত্যাশিত ভাবেই তার সব ক’টি গ্রহণ করেন। বিরোধী বামফ্রন্টের আনা ৯৮টি সংশোধনীর সব ক’টিই খারিজ হয়ে যায়। এসইউসি বিধায়ক তরুণ নস্কর ওই বিলে ১৩টি সংশোধনী আনেন। তার একটি সরকার গ্রহণ করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণকে দলতন্ত্রমুক্ত করতে এবং উৎকর্ষের কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে সরকার প্রথমে অর্ডিন্যান্স জারি করে। কিন্তু পরে সরকার যে বিল তৈরি করে, তার সঙ্গে ওই অর্ডিন্যান্সের কিছু ফারাক ছিল। তাই বিলটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন রাজ্যপাল। তাঁর ‘আপত্তি’ মূলত ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত কমিটিতে উপাচার্যকে ‘নিয়োগকর্তা’ না-করা নিয়ে। অর্ডিন্যান্সে উপাচার্যকে ‘নিয়োগকর্তা’ রাখা হয়েছিল। বিলে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয় ‘এগ্জিকিউটিভ কাউন্সিল’কে (কলকাতা বিশ্বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যেমন ‘সিন্ডিকেট’)। শেষ পর্যন্ত অবশ্য রাজ্যপালের ‘ইচ্ছা’ মেনেই মুখ্য সরকারি সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটির জন্য দু’টি করে মোট ২৬টি সংশোধনী আনেন। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষকদের নিয়োগ কর্তা হলেন উপাচার্যই।
এ দিন উপাচার্য ও শিক্ষক নিয়োগ-পদ্ধতি, উপাচার্যের অপসারণের সংস্থান, কোর্ট এবং কাউন্সিলে ছাত্র ও বিধায়কের প্রতিনিধিত্ব না থাকা প্রসঙ্গেই মূলত সরকার ও বিরোধী পক্ষের বিতর্ক চলে। বামফ্রন্ট মনে করে, ওই বিলে এই পাঁচটি বিষয়ে যা যা বলা হয়েছে, তাতে দলতন্ত্রই আরও মজবুত হবে, গণতন্ত্র সংকুচিত হবে। যে কারণে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র-সহ একাধিক বাম বিধায়ক বিলটি সিলেক্ট কমিটিতে পাঠিয়ে বড় পরিসরে, এমনকী শিক্ষাবিদদের ডেকেও আলোচনার প্রস্তাব দেন। সরকার অবশ্য তা খারিজ করে দেয়।
বাম জমানায় আলিমুদ্দিন থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের যে অভিযোগ বার বার উঠেছে, এ দিন তার উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “আগে উপাচার্য নিয়োগের আগে রাজ্যপালের কাছে তালিকা পাঠানোর সময় তিনটি নাম যে কী ভাবে বাছাই হত, তা তো জানি! অনিলায়ন বা আলিমুদ্দিন থেকে কী ভাবে নিয়োগ হত, সেটাও জানি! সেই রীতি নতুন বিলে রাখতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষাবিদদের হাতে থাকুক, সেটাই চেয়েছেন উনি। তা না হলে তো প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আামাদের প্রতিনিধি বসিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু করিনি।”
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র মেনে নেন, বাম-জমানায় বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ দলীয় হস্তক্ষেপ মুক্ত ছিল না। তাঁর বক্তব্য, নতুন সরকার সেটা করতে চাইলে তা ভাল উদ্যোগ। কিন্তু যে পথে তা করার চেষ্টা হচ্ছে, তা লক্ষ্যের বিপরীত। সূর্যবাবুর যুক্তি, “গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া কোনও জায়গাকে দলতন্ত্রমুক্ত করা যায় না। স্বচ্ছতাও আনা যায় না। দলীয় হস্তক্ষেপ ঠেকাতে চাইলে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র চাই। আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্র খর্ব হয়।” এর পরেই শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন কমিশনের উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বশাসনের দাবি জানান সূর্যবাবু। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত করে নতুন সরকারও যে ‘স্বশাসন’ই চায়, সে কথাও স্পষ্ট করে দেন শিক্ষামন্ত্রী।
সূর্যবাবুর আশঙ্কা, ওই বিলের জেরে উপাচার্য এবং সহ-উপাচার্যের ‘সম্পর্ক’ নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে। কারণ এত দিন উপাচার্য এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে রাজ্যপাল সহ-উপাচার্য নিয়োগ করতেন। নয়া বিল অনুযায়ী এখানে উপাচার্যের কোনও ভূমিকা নেই। মন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেই রাজ্যপাল সহ-উপাচার্য নিয়োগ করবেন। ব্রাত্যবাবুর জবাব, “উপাচার্যের নিয়ন্ত্রণে না থেকে সহ-উপাচার্য স্বাধীন হবেন, সেটাই তো চাই।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষ প্রসঙ্গে ব্রাত্যবাবুর ব্যাখ্যা, “এত দিন কেবল রাজ্যের মধ্যে থেকেই উপাচার্য নিয়োগ হত। এ বার ভিন রাজ্য এমনকী বিদেশ থেকেও যোগ্য ব্যক্তিকে এনে উপাচার্য করার সুযোগ থাকবে।” যদিও সূর্যবাবু মনে করেন, “রাজনীতি-সংযোগ থাকবে না বলে যে কথা বিলে লেখা হয়েছে, তাতে আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন গুণী মানুষ উপাচার্য হতে চাইবেন না। প্রকৃত শিক্ষাবিদ খুঁজতে হলে ওঁদের পিছনে ছুটতে হবে। ওঁরা আমার-আপনার পিছনে ছুটবেন না।” বামেদের বক্তব্য, রাজনৈতিক মত থাকলেই উপাচার্য হওয়া যাবে না, আর নির্বাচিত প্রতিনিধির বদলে মনোনীত প্রতিনিধি থাকলেই বিশ্ববিদ্যালয় দলতন্ত্র মুক্ত হবে, এর ‘যৌক্তিকতা’ নেই। সূর্যবাবুর অভিযোগ, “এমন ভাবে উপাচার্য নিয়োগের কথা বলা হচ্ছে, তাতে তো উপাচার্য মিলবে না, মিলবে এক জন চিফ এগ্জিকিউটিভ অফিসার।” এর রেশ ধরেই সূর্যবাবুর আরও অভিযোগ, “বাণিজ্যে খুচরো বিনিয়োগ রুখেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু শিক্ষার দোকান খোলা হবে। বহুজাতিক সংস্থাগুলি চাইছে এখানে শিক্ষার দোকান খুলতে। তাই উপাচার্যের বদলে সিইও দরকার। বিলের এই সুপারিশ ভবিষ্যতে বিপদ ডেকে আনবে।”
যে ছাত্রদের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হওয়ার অধিকার রয়েছে, ভোটাধিকার রয়েছে, তাঁদের কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট ও কাউন্সিলে রাখা হবে না, সে প্রশ্নও তোলেন বাম বিধায়করা। তাঁদের আরও প্রশ্ন, এ রাজ্যে অনেক পণ্ডিত বিধায়ক রয়েছেন। তাঁদের কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সংস্থায় রাখার সংস্থান থাকছে না। ব্রাত্যবাবুর জবাব, “যে মুহূর্তে সংসদীয় রাজনীতিতে ঢুকেছি, তখন থেকেই আমি রাজনীতিবিদ। শিক্ষাবিদ হলে কলেজেই পড়াতাম। ছুটি নিয়ে এখানে (রাজনীতি) আসতাম না।”
ওই বিলে এশিয়াটিক সোসাইটি, আইএসআই বা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রতিনিধিদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রশাসনিক কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ব্রাত্যবাবু বলেন, “একে-ওকে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে না থাকে, সে জন্যই এই বিল। কিছু ভুলত্রুটি থাকতে পারে। দরকারে পাঁচ বার আইন বদল করব। কিন্তু চেষ্টা করে যাব।” এসইউসি বিধায়ক তরুণবাবুর সংশোধনী মেনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্টে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতিনিধি রাখতে সম্মত হয় সরকার।
|
এক নজরে বিশ্ববিদ্যালয় বিল |
• উপাচার্য নিয়োগে তিন সদস্যের সার্চ কমিটি
• দুর্নীতি, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংযোগ, কাজে ব্যর্থতায় উপাচার্য অপসারণ
• মন্ত্রীর পরামর্শে সহ-উপাচার্য নিয়োগ রাজ্যপালের
• শিক্ষকের নিয়োগকর্তা উপাচার্য
• ছাত্র, বিধায়ক ছাড়াই কোর্ট, কাউন্সিল
• কোর্টে শিক্ষাকর্মী, আধিকারিক প্রতিনিধি
• অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে ছাত্র প্রতিনিধি |
|