তিনি সংসদে নেই। থাকার কথাও নয়। কিন্তু তাঁর অদৃশ্য উপস্থিতি সর্বত্র।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই এ বারের সংসদ অধিবেশনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক শক্তি হিসাবে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি থেকে শুরু করে পেনশন বিল— সর্বত্রই তাঁর মতামত বদলে দিয়েছে সরকারের সিদ্ধান্তকে। এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন, আজ লোকপাল প্যানেলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে তৃণমূলনেত্রীর ভূমিকা।
আজ লোকসভায় সরকারপক্ষ প্রথমে যে বিলটি পেশ করে, তাতে ওই প্যানেলে তফসিলি জাতি, উপজাতি ও মহিলাদের প্রতিনিধিত্বের উল্লেখ থাকলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব ছিল না। খবর পাওয়ার পরই মমতা যোগাযোগ করেন তৃণমূলের লোকসভার নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। মমতা নির্দেশ দেন, অবিলম্বে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে লোকপাল বিলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্তি ঘটাতে। মমতার বক্তব্য, লোকপাল বিল নিয়ে তাঁর দল সরকারের পাশে রয়েছে। কিন্তু সংখ্যালঘুদের সঙ্গে বঞ্চনা করা হলে তৃণমূল তা মেনে নেবে না। সুদীপবাবু তখন সংসদবিষয়ক মন্ত্রী পবন বনশলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পবন নিজে মনমোহন সিংহ এবং প্রণব মুখোপাধ্যায়কে তৃণমূল নেত্রীর বার্তা জানিয়ে দেন। তার পরই লোকপাল প্যানেলে সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের অন্তর্ভুক্তি ঘটে।
বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তিতে ধাক্কা খাওয়ার পর মনমোহন সরকার মমতার সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক চাঙ্গা করার প্রশ্নে কিছুটা সক্রিয় হয়েছে। ইউপিএ-র বৃহত্তম শরিক দল হিসাবে তাঁর সমর্থন ছাড়া কোনও বড় সিদ্ধান্ত যে সংসদে পাশ করানো সম্ভব হবে না, সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব। তাই প্রতি পদক্ষেপে তাঁকে বোঝানোর জন্য চলছে চূড়ান্ত প্রয়াস। প্রধানমন্ত্রী নিজে একাধিক বার মমতাকে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের উপযোগিতা নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বরফ গলেনি। এরপর পেনশন বিল নিয়েও মমতার দ্বারস্থ হতে হয়েছে মনমোহন, প্রণবকে। এ ক্ষেত্রে তাঁর বিরোধিতাকে প্রকাশ্যে চরমে না নিয়ে গেলেও সরকারকে ঢোক গিলতে বাধ্য করেন তৃণমূল নেত্রী। মমতা চিঠি লিখে প্রণববাবুকে জানান পেনশনের অর্থ কতটা সুরক্ষিত থাকবে অথবা সেই অর্থের পরিমাণ কমে যেতে পারে কিনা, সেই বিষয়টি সরকার স্পষ্ট করতে পারেনি। একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, পেনশন প্রকল্পের টাকা ঝুঁকিপূর্ণ কোনও লগ্নি প্রকল্পে বিনিয়োগ করার প্রশ্নে তৃণমূলের স্পষ্ট আপত্তি রয়েছে। বিষয়টি এমন পর্যায়ে যায় যে, সংসদের সূচিতে থাকা সত্ত্বেও বিলটি ফিরিয়ে নিতে হয় সরকারকে।
এর পরে আজ লোকপাল প্যানেল নিয়েও নির্ণায়ক ভূমিকা নিলেন মমতা। সেই প্রসঙ্গে সুদীপবাবুর বক্তব্য, “সংসদের একেবারে শেষে এসেও কেন্দ্রে জোট সরকার সঠিক ভাবে চালানোর প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা ফের প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। সাধারণ মানুষের সমস্যা হবে, এমন কোনও সিদ্ধান্ত তিনি এই অধিবেশনে সরকারকে নিতে দেননি। তা সে খুচরো ব্যবসাই হোক অথবা পেনশন বিল।”
সরকারের ভিতরে থেকেও মমতার এই ‘জনমুখী’ পদক্ষেপে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছে সিপিএম। দলীয় সূত্রের আশঙ্কা, সরকারের মধ্যে থেকেও রাজ্যে কেন্দ্র-বিরোধী রাজনৈতিক পরিসরটি দখল করে নিচ্ছেন মমতা। পেনশন বিল নিয়ে মমতার ভূমিকার কিছুটা সমালোচনা করে সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, “আমরা তো চাই আমাদের নীতি সবাই গ্রহণ করুক। ভুললে চলবে না মমতা যখন এনডিএ সরকারে ছিলেন তখনই নতুন পেনশন প্রকল্প চালু হয়েছিল। ইউপিএ-র সময় এক নীতি আর এনডিএ-র সময় অন্য, এটা দ্বিচারিতা আর সুবিধাবাদী রাজনীতি।”
|