অনেকেই হয়তো ভেবেছেন। কিন্তু সংসদে দাঁড়িয়ে এতটা স্পষ্ট করে কেউ বলেননি। যেমন বললেন লালু প্রসাদ। বা গুরুদাস দাশগুপ্ত। লালুর কথায় হেসে ফেলেছেন অণ্ণা হজারেকে ‘সঙ্গে থাকার’ বার্তা দিতে চাওয়া সুষমা স্বরাজও। আবার গুরুদাসের কথায় টেবিল চাপড়ালেন স্বয়ং সনিয়া গাঁধী।
যে ভাবে অণ্ণা হজারে ও তাঁর শিবির লোকপাল বিলের প্রশ্নে সরকারকে চাপে রেখে আসছিলেন, তা মোটেই ভাল ভাবে নেয়নি অধিকাংশ সাংসদ। কিন্তু দলীয় নীতির প্রশ্নে মুখ বন্ধ রাখতে হয়েছিল তাঁদের। আজ দলমত নির্বিশেষে সেই সাংসদদের ‘ক্ষোভ’-এর কথা সংসদে তুলে ধরতে সক্ষম হলেন আরজেডি প্রধান লালু ও সিপিআইয়ের সাংসদ গুরুদাসবাবু। খোদ লালুর কথায়, “আমি সমস্ত সাংসদের হয়ে আজ বক্তব্য পেশ করছি।” লালুর ওই বক্তব্যকে সমর্থন জানায় গোটা লোকসভা। আসলে আজ দুই নেতার বক্তব্যে সমর্থন জানিয়ে সরকার ও বিরোধী, উভয় পক্ষই অণ্ণা শিবিরকে কড়া বার্তা দিতে চেয়েছে যে, আইন তৈরি হয় সংসদে। অনশন করে বা রাস্তাতে তা হয় না। একই কথা শোনা গিয়েছে লালু এবং গুরুদাস, দু’জনের মুখেই।
কী বললেন লালু? বললেন, “তিন-চার জন মানুষ সংসদকে বলে দেবেন কী করতে হবে, সেটা হয় না।” বললেন, “ফুটপাথে বসে সংসদ চালানো যায় না।” আর কমিউনিস্ট গুরুদাস সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন, “অণ্ণা দ্বিতীয় জাতির জনক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। কিন্তু উনি ভুলে যাচ্ছেন দেশে এক জনই জাতির জনক। তিনি মহাত্মা গাঁধী।” অণ্ণা শিবিরের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাঁরও কটাক্ষ, “আইন প্রণয়নের জন্য সংসদ রয়েছে। আইন কখনও রাস্তায় তৈরি হতে পারে না।” লালুর সূত্র ধরে বলতে উঠে গুরুদাসবাবুর আরও বক্তব্য, নির্বাচিত নন, এমন সমাজসেবীর কাছে কখনওই সংসদের সার্বভৌমত্ব সমর্পণ করা উচিত নয়।” গুরুদাসের এই বক্তব্যের সময়ও টেবিল চাপড়ে সমর্থন জানান সনিয়া-রাহুল।
|
শুধু এই কথা নয়, আজ যে ভাবে এই দু’জনের বক্তব্যের সময় সাংসদেরা সমর্থন জানিয়েছেন, তা এক কথায় নজিরবিহীন। বিজেপির এক সাংসদের কথায়, “দলের নীতির জন্য অনেক কিছু বলা সম্ভব হয় না। কিন্তু আজ দুই নেতা কার্যত আমাদের মনের কথাই তুলে ধরেছিলেন।”
তবে অণ্ণা শিবিরের চাপের মুখে পড়ে সরকার যে ভাবে তড়িঘড়ি লোকপাল বিল আনতে বাধ্য হয়েছে, তারও তীব্র সমালোচনা করেন লালু। বলেন, “এক জন অনশনকারী, এক জন প্রাক্তন পুলিশকর্তা, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার লোক, এই ধরনের চার ব্যক্তি সরকারকে হুমকি দিচ্ছে। আর সরকার তাঁদেরই ভয়ে ওই বিল নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।” পাশাপাশি অণ্ণার প্রতি তাঁর পরামর্শ, শরীরের যত্ন নিন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, অণ্ণাদের আন্দোলনের প্রতি এ দিন সংসদের বাইরে থেকেও কটাক্ষ এসেছে। অর্থনীতিবিদ তথা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জগদীশ ভাগবতী মনে করেন, যে ভাবে সরকার অণ্ণাদের সামলেছে, তা একেবারে সঠিক। নাগরিক সমাজ পরামর্শ দিতে পারে, কিন্তু তা সরকারের ঘাড়ে চাপানোর জন্য জোর করতে পারে না। তাঁর মন্তব্য, “আবার এই সমাজসেবীদের মধ্যে গোলমাল দেখে আমেরিকার ফ্রিস্টাইল কুস্তির কথা মনে পড়ে যায়!”
নতুন বিলে প্রধানমন্ত্রীর পদকে রক্ষাকবচ-সহ লোকপালের আওতায় রাখা হয়েছে। কিন্তু লালু স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন, সরকারের এই মতের বিরুদ্ধে তিনি। আরজেডি প্রধানের বক্তব্য, “প্রধানমন্ত্রী দেশের অন্যতম সর্ব্বোচ্চ নাগরিক। তাঁকেও যদি লোকপালের আওতায় নিয়ে আসা হয় তা হলে গোটা বিশ্বের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি কী হবে?” সরকার পক্ষ তো বটেই বিরোধী শিবিরও লালুর এই যুক্তিকে সমর্থন জানান। আর প্রাক্তন সাংসদের লোকপালের আওতায় নিয়ে আসার যে দাবি অণ্ণা তুলেছেন তা কটাক্ষ করে লালু বলেন, “প্রাক্তন সাংসদেরা শৌচাগারে পর্যন্ত জায়গা পান না। আর তাঁদের বলা হচ্ছে লোকপালের আওতায় নিয়ে আসতে!”
বস্তুত, বহু দিন পরে আজ পুরনো লালুর ঝলক দেখল সংসদ। যে রসবোধের জন্য লালু বিখ্যাত, আজ তাঁর বক্তৃতায় তা বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। লালুর সময়েও টেবিল চাপড়ে সমর্থন জানাতে কসুর করেননি সনিয়া-রাহুল বা চিদম্বরমের মতো সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব।
|