লোকপাল বিল সংসদে পেশ হয়েও সরকার বনাম অণ্ণা হজারে দ্বৈরথ ঘোচার কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। বরং পুরনো লোকপাল বিল প্রত্যাহার করে কর্মিবর্গ দফতরের প্রতিমন্ত্রী ভি নারায়ণস্বামী আজ যে নতুন বিলটি পেশ করলেন, তাতে অণ্ণাদের অনেক দাবিই মানেনি সরকার। শুধু তাই নয়, তামাম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে লোকপালের আওতায় রেখে বার্তাও দেওয়া হল অণ্ণা, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, কিরণ বেদীদের।
স্বাভাবিক ভাবেই এই বিলকে অণ্ণা ‘অত্যন্ত দুর্বল’ আখ্যা দিয়েছেন। ফের অনশনে আন্দোলনের হুমকিও দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি সনিয়া গাঁধীকে প্রকাশ্য সভায় বিতর্কে যোগদানের জন্য আহ্বানও জানিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে ২৭ ডিসেম্বর থেকে সংসদে লোকপাল বিল নিয়ে সবিস্তার আলোচনা ও ভোটাভুটি কোন পথে যায়, সে দিকে তাকিয়ে রয়েছেন সকলে।
সরকার আজ যে বিলটি পেশ করেছে, তা অণ্ণা হজারেদের দাবি থেকে অনেকটাই আলাদা। সরকারের এক শীর্ষ নেতার কথায়, লোকপালকে সমান্তরাল ক্ষমতার কেন্দ্র করে তুলতে চায়নি সরকার। দুর্নীতি দমনের জন্য যেটুকু ক্ষমতার দরকার, সেটুকুই দিয়েছে। সেই লক্ষ্যে সিবিআইকে লোকপালের আওতায় রাখা হয়নি। উল্টে সিবিআইয়ের তদন্তে লোকপাল যাতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে, তা-ও সুনিশ্চিত করা হয়েছে। পাশাপাশি লোকপালকেও নজরদারির আওতায় রাখা হয়েছে বিলটিতে। অনিয়মের অভিযোগ উঠলে লোকপালের সদস্যকে অপসারণের প্রস্তাব রয়েছে। একই সঙ্গে তামাম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে লোকপালের আওতায় রাখা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বিশেষ করে যারা বিদেশ থেকে অনুদান পায়, তাদের লোকপালের আওতায় না রাখার দাবি ছিল অণ্ণাদের। কিন্তু সেই দাবিও সরকার মানেনি। বরং বলা হয়েছে, কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দশ লক্ষ টাকার বেশি বিদেশি অনুদান অথবা সরকারের অনুদান পেলে তার কর্ণধারেরা লোকপালের আওতায় থাকবেন।
তবে এ দিন সংসদে কিন্তু লোকপাল বিতর্কে যাবতীয় আলো শুষে নিয়েছে সংখ্যালঘু বিতর্ক। মূলত লোকপাল বিলের চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তুতের আগে প্রধানমন্ত্রীর ডাকা সর্বদল বৈঠকেই লোকপাল সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সংরক্ষণের জোরালো দাবি তোলে সপা-বসপা এবং লালুর দল আরজেডি। সরকার সেই দাবি মেনে নিয়ে চূড়ান্ত খসড়ায় রেখেওছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লোকপাল বিলের যে প্রতিলিপি আজ সাংসদদের বিতরণ করা হয়, তাতে সংখ্যালঘু সংরক্ষণের বিষয়টির উল্লেখ ছিল না। স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুলায়ম সিংহ, লালু প্রসাদ, তৃণমূল কংগ্রেস ও বামেরা। পরে লোকসভার নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায় জানান, সংখ্যালঘু সংরক্ষণের বিষয়টি বিলে রাখার সিদ্ধান্ত সরকার আগেই নিয়েছিল। কিন্তু ভুল করে বিলে রাখা হয়নি। তাই সংশোধন করে নেওয়া হয়েছে।
স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপি এর বিরোধিতা করে। কিন্তু তত ক্ষণে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, গোড়ায় বিলে সংখ্যালঘু সংরক্ষণের বিষয়টি না রাখা সরকারের কৌশল নয়তো? কেন না, শুধু সংরক্ষণ বিতর্ক নিয়ে আলোচনার জেরেই লোকপালের আওতায় প্রধানমন্ত্রীর পদ, সিবিআই, আমলাতন্ত্রের নিচুস্তরকে রাখা না-রাখা নিয়ে বিতর্ক আজ অনেকটা চাপা পড়ে গিয়েছে। ফলে কিছুটা বেকুব বনেছে বিজেপি।
|
একনজরে লোকপাল |
• আদতে দু’টি বিল। প্রথমটি লোকপাল ও লোকায়ুক্ত গঠনের লক্ষ্যে। এ’টি পাশ করাতে সাধারণ গরিষ্ঠতাই যথেষ্ঠ
• দ্বিতীয় অংশটি সংবিধান সংশোধনের জন্য। সেটি পাশ করাতে কমপক্ষে সভার অর্ধেক সাংসদকে উপস্থিত থাকতে হবে। উপস্থিত সাংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার
• লোকপালের ৯ সদস্য নিয়োগে ন্যূনতম ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ নীতি। তফসিলি জাতি-উপজাতি, ওবিসি ও মহিলাদের পাশাপাশি সংখ্যালঘুদেরও সংরক্ষণ থাকছে
• প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধী নেতা ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বা রাষ্ট্রপতি মনোনীত জুরি মিলে লোকপালের সদস্য বাছবেন
• সংসদের কাছে দায়বদ্ধতা। লোকপাল-সদস্যদের ইমপিচ করা যাবে
• আওতায় প্রধানমন্ত্রীর পদ থাকলেও আন্তর্জাতিক বিষয়, নিরাপত্তা, পরমাণু ও মহাকাশ সংক্রান্ত বিষয়ে রক্ষাকবচ থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিতে হলে লোকপালের ৯ সদস্যের মধ্যে ৭ জনের সহমতি চাই
• অভিযোগ পেলে তবেই তদন্ত, স্বতঃপ্রবৃত্ত ভাবে নয়
• লোকপাল সিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিলে, সিবিআই সরাসরি লোকপালকে রিপোর্ট দেবে।
• সরকারি কর্মীদের শাস্তি দিতে অনুমতি লাগবে না
• সিভিসি-র মতো অন্য সংস্থাকে দিয়েও তদন্ত করাতে পারবে লোকপাল
• সরকারি বা ১০ লক্ষ টাকার উপরে বিদেশি সাহায্য পায় এমন এনজিও-রাও লোকপালের আওতায়
• লোকপালের তদন্তের পর বিচারের জন্য বিশেষ আদালত |
|
বিলের খুঁটিনাটি নিয়ে বিতর্কে না গেলেও একটি ধারা নিয়ে আজ বিজেপি-সহ অনেক রাজনৈতিক দলই আপত্তি জানিয়েছে। তা হল, রাজ্যস্তরে লোকায়ুক্ত নিয়োগের বিষয়টি। সরকার যে লোকপাল বিল আজ পেশ করেছে, তার মধ্যেই রাজ্যস্তরে লোকায়ুক্ত গঠনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু লোকসভার বিরোধী দলনেত্রী সুষমা স্বরাজ আজ বলেন, সরকার এ ভাবে রাজ্যগুলিকে বাধ্য করতে পারে না। এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মেরুদণ্ডে আঘাত হানবে। বিশেষ করে বিহার, উত্তরাখণ্ডের মতো অনেক রাজ্য ‘ভাল’ লোকায়ুক্ত আইন প্রণয়ন করেছে। তারা কেন্দ্রের ‘খারাপ’ বিল গ্রহণ করবে কেন? লোকপাল বিলে সমর্থন জানালেও একই মত প্রকাশ করেছে এডিএমকে, ডিএমকে, সংযুক্ত জনতা দলের নেতারা।
পাশাপাশি আজ সিপিআই নেতা গুরুদাস দাশগুপ্ত-সহ বিরোধী শিবিরের অনেক নেতা এই প্রশ্নও তুলেছেন, অণ্ণাদের হুমকিতে সরকার কেন লোকপাল বিলটি নিয়ে তাড়াহুড়ো করছে? তার অবশ্য জবাব দিতে ছাড়েননি লোকসভার নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, সরকার কোনও তড়িঘড়ি করেনি। লোকপাল বিতর্ক গত চল্লিশ বছর ধরে চলছে। তা ছাড়া, এপ্রিল থেকে এ ব্যাপারে আলোচনা চালাচ্ছে সরকার। পাশাপাশি বাম-বিজেপিকে কটাক্ষ করে প্রণব এ-ও বলেন, সংসদের সর্বোচ্চতা নিয়ে এতই উদ্বেগ থাকলে অণ্ণার ধর্ণা মঞ্চে কেন তাঁরা সামিল হয়েছিলেন?
দিনের শেষে লোকপাল বিল ধ্বনি ভোটে পেশ হলেও, গত রাত থেকে এ ব্যাপারে কম নাটক হয়নি। বিলের প্রতিলিপি গত রাতে সাংসদদের কাছে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু গত রাতে সাংসদদের ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হয়, বিল এখনও ছাপা হয়নি। তার পর আজ সংসদের অধিবেশন শুরু হলে সকাল ১১টা নাগাদ বিলটি সাংসদদের বিলি করা হয়। কিন্তু বিলটি পেশ করতে সময় নেয় সরকার। আর সেই ফাঁকে সংখ্যালঘু সংরক্ষণের দাবিতে সরব হন লালু-মুলায়মরা। সব শেষে বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ লোকসভায় বিলটি পেশ হয়। |