মাসে-মাসে নয়। ছ’মাস অন্তরও নয়। বছরে মাত্র এক বার অস্ত্রচর্চা করতে হবে পুলিশের কনস্টেবলদের। পুলিশি বিধিতে এমনটাই বলা আছে।
কিন্তু বিধি যা-ই থাকুক, পুরো চাকরি জীবনে তিন-চার বারের বেশি অস্ত্রচর্চার সুযোগ পেয়েছেন কি না, তা মনে করতে পারছেন না রাজ্য পুলিশের অনেক কনস্টেবলই!
পশ্চিমবঙ্গে পুলিশকর্মীদের প্রশিক্ষণ নিয়ে সম্প্রতি কড়া মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মগরাহাটে পুলিশের গুলিতে তিন জনের মৃত্যুর পরে তিনি বলেছিলেন, “পুলিশের কারও কারও প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। বন্দুক ঠিক ভাবে চালাতেও পারেন না অনেকে।” বস্তুত মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্য যে নেহাত কথার কথা নয়, কনস্টেবল-প্রশিক্ষণের ছবিটাই তা বলে দিচ্ছে। সেটা কী রকম?
পুলিশের নিয়মে থানায় যোগদানের আগে কনস্টেবলদের ন’মাসের তালিম হওয়ার কথা। আইনের খুঁটিনাটি জানা, শারীরিক কসরৎ ছাড়াও মূলত অস্ত্রচালনা শেখার জন্য। কিন্তু প্রশিক্ষণের সেই সময়টুকুও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে বছর দেড়েক আগে। রাজ্যের এক পুলিশ-কর্তা বলেন, “থানাগুলোয় পুলিশকর্মীর অভাব মেটাতে প্রাক্তন ডিজি ভূপিন্দর সিংহের আমলে পুলিশ ট্রেনিং কলেজে কনস্টেবলদের প্রশিক্ষণের সময় ন’মাস থেকে কমিয়ে ছ’মাস করা হয়। তখন বলা হয়েছিল, বাকি তিন মাসের প্রশিক্ষণ তাঁরা জেলায় পোস্টিং পেয়ে শেষ করবেন।”
অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা আর হয়ে ওঠেনি। কেন?
এক পুলিশ-কর্তার ব্যাখ্যা: কোনও জেলাতেই প্রশিক্ষণের ঠিকঠাক পরিকাঠামো নেই, সময়ও নেই কারও। জেলায় জেলায় পুলিশকর্মীর এত অভাব যে, কনস্টেবলদের কার্যত অর্ধ-প্রশিক্ষিত অবস্থাতেই থানায় ডিউটিতে লেগে পড়ার নির্দেশ দিতে বাধ্য হন অনেক এসপি। এবং এরই ফলে উত্তেজিত জনতাকে সামলাতে গিয়ে কনস্টেবলদের একাংশ ‘ভুল কাজ’ করে ফেলেন বলে পুলিশকর্তাদের একাংশের অভিমত। যাঁদের আক্ষেপ, “সাধারণত ১৫-১৬ বছরের আগে এক জন কনস্টেবলের পদোন্নতি হয় না। এর মধ্যে খুব বেশি হলে তিনি হয়তো তিন-চার বার অস্ত্রচর্চার বিশেষ শিবিরে যোগ দেন। বাস্তব পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও চোখ বুজে থাকতে হয়।”
মহাকরণ-সূত্রের খবর: মাস তিনেক আগে রাজ্য পুলিশের ডিজি (প্রশিক্ষণ) বাগীশ মিশ্র কনস্টেবলদের জন্য ফের ন’মাসের ট্রেনিং-কোর্স চালু করতে ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়কে প্রস্তাব দিয়েছেন। পুলিশ ট্রেনিং কলেজের এক কর্তা বলেন, “কাগজে-কলমে ছ’মাসের প্রশিক্ষণ লেখা থাকলেও সাপ্তাহিক দু’দিন ছুটি, বিভিন্ন সরকারি ও অসু্স্থতাজনিত ছুটি, এবং অন্য ব্যক্তিগত নানা কারণে কনস্টেবলদের কার্যত গড়ে ৬৫ দিনের বেশি প্রশিক্ষণ হয় না। এটা একেবারেই যথেষ্ট নয়।” আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলানো দিন দিন যে ভাবে জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, তাতে কনস্টেবলদের বছরে নিদেনপক্ষে দু’বার অস্ত্রচালনার তালিম নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন ওই কর্তা।
পুলিশের নিয়মে কনস্টেবলদের বছরে এক বার অস্ত্রচর্চা ও প্রশিক্ষণ আবশ্যিক করা হয়েছে বটে, কিন্তু লোকাভাবের দরুণ তা-ও প্রায় শিকেয় উঠেছে। একাধিক পুলিশ-কর্তার বক্তব্য, “পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিত্যনতুন অস্ত্র পুলিশের হাতে আসছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কনস্টেবলেরাই তা ব্যবহার করেন। তাই তাঁদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রচর্চা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। চাকরির উন্নতির ক্ষেত্রেও সরকারের উচিত বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া।” একই সঙ্গে এ রাজ্যের পুলিশকর্তাদের অনেকের খেদ, “অন্য অনেক রাজ্যে পুলিশের একাধিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে। বছরভর সেখানে অস্ত্র-চর্চা ও নানান প্রশিক্ষণ চলে। এমনকী, বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য পশ্চিমবঙ্গের পুলিশও সেখানে যায়। কিন্তু এখানে তেমন কিছু গড়ে ওঠেনি। ভরসা সেই ব্যারাকপুরের পুলিশ ট্রেনিং কলেজ।”
উপরন্তু সেই ‘ভরসা’র পরিসরও এ বার ছোট হয়ে যাচ্ছে!
কারণ, রাজ্যের বৃহত্তম ও প্রাচীনতম এই পুলিশ প্রশিক্ষণকেন্দ্রের একাংশ রেলের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান সরকার। মহাকরণে এক পুলিশ-কর্তার মন্তব্য, “এমনিতেই ব্যারাকপুর পুলিশ ট্রেনিং কলেজের আয়তন প্রয়োজনের তুলনায় বেশ ছোট। অল্প দূরত্বে জনবসতি থাকায় চাঁদমারি করতে হয় খুবই সাবধানে। সেটা আরও ছোট হচ্ছে। মেট্রোর রেল স্টেশন ও কারশেড তৈরির জন্য পুলিশ ট্রেনিং কলেজের প্রায় ১৪-১৫ একর জমি বিজ্ঞপ্তি জারি করে দিয়ে দেওয়া হয়েছে রেলকে।” |