|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় গল্প |
মোটোখোকো |
তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় |
চওড়া কপালের তিনটে সমান্তরাল ভাঁজ যেন উত্তুঙ্গ আকাশচারী চিলের চোখ দিয়ে দেখা তিনটে মজা নদী। তার ওপরে ঘামের বিন্দুগুলো বালির দানার মতো চিকচিক করছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। পাতার ফাঁক দিয়ে আসা ঝাঁঝালো রোদের ফালিটা সরে এসে ঈষৎ বেগুনি হয়ে পড়েছে ওর মুখে। আলকাতরা মাখানো বাতিল ব্রাশের মতো খোঁচাখোঁচা চুল-দাড়ি-গোঁফ তেতে উঠছে। একটা মাছি প্রায়ই উড়ে এসে ডান গালের তিলটার ওপর বসছে। কাকটাও অনেকক্ষণ থেকে চেল্লামেল্লি করছিল। অনেকগুলো অস্বস্তি এক জায়গায় হওয়ায় মোটোখোকোর ঘুম ভেঙে গেল। ভারী শরীরখানা পার্কের চেয়ার থেকে তুলে গোলগোল চোখে তাকিয়ে মস্ত একটা হাই তুলল সে।
ওর নাম মোটোখোকো কেন কেউ জানে না। ডাকনাম জিনিসটা অবশ্য ধ্বনিসর্বস্ব হওয়াই ভাল, তা ছাড়া ভবঘুরেদের নামকরণের ব্যাপারে কে কবে অর্থের তোয়াক্কা করেছে? যদিও এ ক্ষেত্রে অনুমান করাই যায় যে, শব্দটা মোটা-খোকার অপভ্রংশ। তবে সে মোটেও খোকাটি নয়, দিব্যি এক আঁতকা মাঝবয়সি পুরুষমানুষ, ভয়াল দর্শন স্বঘোষিত কালীভক্ত। চওড়া কাঁধ, সারা গা ভর্তি চুল, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা পরনে লাল শালু, গলায় রুদ্রাক্ষ পরে একটা সিঁদুর মাখানো ছোট ত্রিশূল হাতে লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুর্বিনীত হানাদারের মতো দেহের ভাষা। যেন মানিকতলা কালীবাড়ির কালো মুষকো ষাঁড়টার মানব-সংস্করণ।
এলাকার ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে সে এক মূর্তিমান ত্রাস। চলা ফেরার পথে ওদের দেখে কটমট করে তাকিয়ে সে যে কী আনন্দ পায় সে-ই জানে। কাঁদোকাঁদো মুখগুলো দেখে ভেতরে ভেতরে গর্বিত হয়। বদ খেয়াল চাপলে ভয়-চকিত শিশুটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ঘড়ঘড়ে আসুরিক গলা বাজিয়ে বলে অ্যাই, বদমাইশি করলে সোজা তুলে নিয়ে যাব। কোথায় গেল আমার ঝোলাটা? গোলগোল ঘোলাটে চোখগুলোর নীচে বাচ্চাটা যখন থরথর করে কাঁপছে, পাশে দাঁড়ানো অভিভাবকটির ঠোঁটে তখন টুকরো হাসি। অভিভাবকের প্রশ্রয় পেলে মোটোকে আর দেখে কে।
যে বাচ্চাগুলো খেতে গিয়ে কান্নাকাটি জুড়েছে, পড়ায় অমনোযোগী হচ্ছে, মহার্ঘ জিনিসের বেমক্কা বায়না করছে বা বাবা মা-র কথা অমান্য করে বেঁকে বসেছে তাদের মোটোখোকোর ভয় দেখানো হয়। মোটোখোকোর ছবিটা মনের মধ্যে ভেসে উঠলেই ওরা শিউরে ওঠে, মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়, কেউ কেউ প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে বেমালুম। সবচেয়ে বেয়াড়া ছেলেটাও তখন নিতান্ত বাধ্য আর চরম দস্যি মেয়েটা কাঠের পুতুল। স্বপ্নের ভেতরেও কেউ কেউ মোটোখোকোর পায়ের শব্দ শুনতে পায়, দশের নীচের অনেকেই ঘুমের মধ্যে ডুকরে কেঁদে ওঠে। এই সব নানা কারণে সে অচিরেই এ তল্লাটের অভিভাবকদের কাছে এক প্রকার মুশকিল আসান হয়ে উঠেছে আর নিজের কাছে ওই ভয়ানক মূর্তিটা হয়ে উঠেছে ভদ্রলোকি সমাজে উঁকি মারার বৈধ ছাড়পত্র।
যা-ই হোক অনেকক্ষণ হল বিকেল হয়েছে বুঝতে পারেনি মোটো। ঘুমভাঙা চোখে ভ্যাবলার মতো বসে ছিল কিছুক্ষণ। কাঁচা সুপুরির নেশাটা যে এত কড়া হবে ঠাহর করতে পারেনি। পাঁই পাঁই করে মাথা ঘুরতে থাকায় শুয়ে পড়েছিল এখানে। ও না থাকলে ছেলেমেয়েগুলো সিমেন্টের এই ছাতাটাকে ঘিরে গোল গোল করে ছুটে খেলা করতে পারত। কিন্তু আজ আর ওরা জায়গাটার ত্রিসীমানায় আসছে না। মোটো সেটা আন্দাজ করে উঠে দাঁড়ায়। পুরু ঘাসের স্তরের ওপর দিয়ে ভারী ভারী পা ফেলে চলে যাওয়ার সময় ছ’সাত বছরের মেয়েটাকে চোখে পড়ে তার। গাল দুটো মোমের মতো, মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। মেয়েটাকে কোলে তুলে আদর করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু মেয়েটার দিকে এগোতেই বিপত্তি, মেয়েটা চিৎকার করে ওর ঠাকুমার দিকে মরিয়া দৌড়। কোলে মুখ লুকিয়ে সে কী কান্না!
হতাশ মোটো নোংরা দাঁত বের করে হাসে। এ এক অদ্ভুত সমস্যা, স্নেহভরে কোনও বাচ্চার দিকে এগোতে এগোতে যাওয়ার সবচেয়ে বড় বাধা ওর চেহারাটা। ওই রকম দাড়ি জটা অধ্যুষিত মুখে মমতার চিহ্ন ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। অথচ বাচ্চাদের দেখলেই পা দুটো স্বয়ংক্রিয় হয়ে সে-দিকে চলতে শুরু করে, চোখ দুটো ওদের খুব কাছ থেকে দেখতে চায়। বাচ্চাগুলো যেটা ভুল বোঝে, সেটাই তো স্বাভাবিক। তাই বলে ওর মতো আধদামড়ার কি ওই অবোধগুলোর ওপর অভিমান করা চলে? মোটোটা চিরকালই যেমন গোঁয়ার তেমন নির্বোধ। বয়সের সঙ্গে শরীরটাই শুধু বেড়েছে, বুদ্ধি কাজ করে বেশ খানিকটা দেরিতে।
তবে এ সব ওর এক অন্যায় রসিকতা। কিন্তু কিছু করার নেই, এমনিতে তো ওরা ওকে কাছে ভিড়তে দেবে না। তাই কাছে ঘেঁষতে হয় ভয়ানক ছলে। ভয়াবহতার মধ্যে বেশ একটা গাম্ভীর্য আছে, অন্য একটা ওজন। নেচে-কুঁদে, জিভ বের করে, শিস দিয়ে, মাথায় শিং-এর মতো আঙুল দাঁড় করিয়ে, ডুগডুগি বাজিয়ে বা যে করেই হোক নিজেকে ওদের কাছে মজাদার প্রমাণ করার চেষ্টা করতেই পারত সে, কিন্তু তাতে বাচ্চাগুলোর কাছে ওর গুরুত্ব কমে যেত, তা ছাড়া ও সব তার একেবারেই আসে না।
অবশ্য আরও একটা কারণ আছে। জলাটার ধারে বেঁটে বটগাছের নীচে, নিজের হাতে বসানো দক্ষিণা কালীমূর্তিটার চাতালে সে রীতিমতো তন্ত্র সাধক। বিশ্বাসী অনেকে তাকে ঘিরে অলৌকিক গন্ধ পেয়েছে, তাই খ্যাপা মা-র সামনে রাখা অ্যালুমিনিয়ামের থালাটায় নিয়মিত খুচরো পয়সা পড়ার ঠুং ঠাং শব্দগুলোর স্বার্থে তাকে মেজাজ নিয়ে থাকতেই হয়। যদিও পাড়ার ফক্কড় ছেলেপিলের মধ্যে সেই ভারিক্কি ভাবটা বজায় রাখা যায় না। ওদের খিস্তি-খেউড় রঙ্গ-রসিকতায় অংশ নিতে না পারলে একা হয়ে যাওয়ার ভয় থেকে যায়।
রাস্তার ওপারে মাঙ্গলিক-অ্যাপার্টমেন্টের গ্রাউন্ড ফ্লোরে আজ বেশ লোক সমাগম। ক’টা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে, গোটা সাতেক রিকশা। অভিভাবকরা আসছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। গেটটা বড় বড় বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে, দু’পাশে বেশ কিছু মিকি-মাউস, ডোনাল্ড-ডাক, টম-জেরির কাট আউট। মজার ছড়ার গান বাজছে লো ভলিউমে। আরও দু’একটা পরিবার এসে পৌঁছল বাচ্চা নিয়ে। লম্বা এক জন লোক অটো থেকে নামছে একটা বছর আটেকের ছেলে কোলে নিয়ে, পাশের বাচ্চাটার হাত দুটো দু’পাশ থেকে ধরে গেট দিয়ে ঢোকাচ্ছে ওর বাবা-মা। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বড়লোকদের এই সব আদিখ্যেতা দেখলে গা জ্বলে, আতুআতু করে ওগুলোর মাথা খাচ্ছে। মোটো পান-বিড়ির দোকানের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে ওখানে একটা স্কুল উদ্বোধন হচ্ছে। লোক থাকার ফেলাটে ইস্কুল? ইস্কুল বাড়ি ছাড়া ইস্কুল? কে জানে আজকাল কত কী হচ্ছে।
মোটো রাস্তা পেরিয়ে ফ্ল্যাট বাড়িটার দরজার কাছে গিয়ে ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করে। সন্দেহপ্রবণ বিহারি দারোয়ানটা ওকে ভুরু ঝাঁকিয়ে বলে, ইধার ক্যা হ্যায়, ভাগো ইঁহাসে, ভাগো। মোটো দাঁত খিঁচিয়ে বলে, ঘ্যাঁও। কৌতূহলী মোটো অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আর নাম নেই। আশপাশে কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করার পর তাকে চলে যেতেই হত। ও দিকে আজ ভারত-ইংল্যান্ড ক্রিকেট ম্যাচ উপলক্ষে বাদুড়তলা ক্যারমের ঠেকে ফ্রেন্ডস ক্লাবের ফিস্ট। রাতে দেদার পাঁঠার মাংস রুটি খাওয়া হবে। এ সপ্তাহটা সে দিক থেকে ভালই কেটেছে। গত পরশু পুলিশ ফাঁড়ির পেছনে নির্মীয়মাণ বহুতলটার ছাদ ঢালাইয়ের পঙ্ক্তি ভোজে ও ডাক পেয়েছিল মিস্ত্রিদের সঙ্গে খাতিরের সুবাদে।
পর দিন সকাল সকাল এ চত্বরে পাক মেরে গেছে মোটো, কিন্তু ছেলেমেয়েগুলো আসেনি। চায়ের দোকানের কে একটা বলল ওটা বিকেলের ইস্কুল। বিকেলের ইস্কুল ব্যাপারটা বেশ নতুন লাগে। ওদের এলাকায় বাচ্চাদের ইংরেজি ইস্কুলটা শুরু হয় সকাল সাতটায়, সরকারি প্রাইমারিটা যেখানে সব গরিব বাপমায়ের ছেলেপিলে পড়ে সেটারও প্রার্থনার ঘণ্টা পড়ে সাতটায়। এলাকাটা তাদের না, তাই প্রকট কোনও কৌতূহল দেখানোর ঝুঁকি নেয়নি সে। দুপুর গড়াতে না গড়াতেই মোটো নজর রাখতে শুরু করে দিয়েছিল সামনের রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে। খর রোদ আস্তে আস্তে জায়গা করে দিচ্ছে আর একটা গুমোট বিকেলকে।
অভিভাবকদের সঙ্গে বাচ্চাগুলো আসতে শুরু করেছে। কিন্তু ওদের পিঠে কোনও ব্যাগট্যাগ নেই। রাস্তার এ পার থেকে যতটা আন্দাজ করা যায় ছেলেমেয়েগুলো একটু বেশিই শান্ত, অভিভাবকদের মুখেও কথা নেই। অন্যান্য ইস্কুলে পড়া এই বয়সি আজকালকার বাচ্চাদের শরীরে একটা বেপরোয়া ভাব থাকে, একটা অস্থিরতা। বাড়ির লোকগুলোও খুব উদ্ধত হয়। কিন্তু এরা সে রকম না। তার চেয়ে বড় কথা হল অভিভাবকগুলোর বেশির ভাগই বাচ্চাদের সঙ্গে ইস্কুলের ভেতরে সেই যে ঢুকল আর বেরোল না। ইস্কুলটায় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বাবা-মাগুলোকেও পড়ায় নাকি! তবে কিছু অভিভাবক ছড়িয়েছিটিয়ে অপেক্ষায় আছে বাইরে; তাদের মধ্যে গোটা তিনেক পুরুষ চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। মোটো রাস্তা পেরিয়ে এ দিকে চলে আসে।
একটা লোক সিমেন্টের বেড় দিয়ে বাঁধানো ছাতিম গাছটার নীচে মাথা নিচু করে বসে। মোটো ওর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে সশব্দে গলা ঝাড়ে। লোকটা মাথা তুলে ওর দিকে তাকায়। পায়ের কাছে পড়ে থাকা শুকনো পাতার মতোই বিবর্ণ ভঙ্গুর মুখটা। চোখেমুখে খুব একটা উৎসাহ নেই, মোটোর দিকে এক পলক তাকিয়ে লোকটা আবার নিজের ভেতরে সেঁধিয়ে গেল। হাতখানেক দূরে একটা ছেঁড়া খবরের কাগজের প্রান্ত পড়েছিল, সময় কাটছে না বলেই বোধ হয় লোকটা সেটা তুলে পড়ছিল। মোটো দ্বিধা ঝেড়ে বসে পড়ল ওর কাছেই।
ক’টা বাজে? এমনিতে সময়ের ধার ধারে না, তবু কথা বলার ছুতো খুঁজে মোটো জিজ্ঞেস করে।
পাঁচটা পনেরো। উত্তরকারী ম্লান চোখে তাকায়। লোকটা রীতিমতো সুদর্শন, উঠে দাঁড়ালে ছ’ফুটের কাছাকাছি লম্বা হবে। গালে বেশ ক’দিনের না-কাটা দাড়ি, অবিন্যস্ত চুল।
বাচ্চাকে ইস্কুলে দিয়ে এলেন?
হ্যাঁ, আমার মেয়ে...।
আপনি ভেতরে যাবেন না? আর বাবারা অনেকে যে ভেতরে রইল!
ভেতরে ওর মা আছে।
আচ্ছা, এটা কী রকম ইস্কুল। বিকেলবেলা, ছেলেপিলে বাপ-মা একসঙ্গে কিলাস, আর সব ইস্কুলে তো...?
আসলে ওরা তো সব বিশেষ চাহিদাযুক্ত বাচ্চা, ওরা ঠিক আর দশটা বাচ্চার মতো না, তাই গার্জেনদের পাশে থেকে বুঝে নিতে হয় কী করে ওদের শেখাতে হবে।
বিশেষ চাহিদা মানে, কীসের চাহিদা? মেয়ে খুব বেয়াড়া, খুব বায়না? আমার এলাকার বাচ্চারা আমাকে দেখলেই সব ঠান্ডা। মোটো হাসে। আর দশটা বাচ্চার মতো না মানে? আমার কথা শুনলে সব বাচ্চা ঢিট, অন্য এলাকার লোক, তাই জানেন না।
না, না। সে সব চাহিদা না, সে সব বায়না থাকলে তো ভালই হত। লোকটার ঠোঁটে বিষণ্ণ হাসি। আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারলাম না। ওরা আসলে পিছিয়ে পড়া বাচ্চা, আর দশটা শিশুর মতো ওদের মানসিক বিকাশ হয়নি, ওরা নিজেদের জগতে, নিজের মতো থাকে। আমাদের কথায় সাড়া দিতে দেরি করে। সাড়া দেয় না তা নয়, কিন্তু ছেঁড়া ছেঁড়া প্রসঙ্গহীন কথা, সে সব বোঝার অনেক কৌশল আছে। অনেক ধৈর্য লাগে, আরও অনেক বেশি ধৈর্য...। লোকটার কথাগুলো অন্তর্মুখী হতে হতে শ্রুতিগ্রাহ্যতা হারাতে থাকে।
ভদ্রলোকেদের কথার হেঁয়ালি তার অসহ্য লাগে। এরা সোজা কথা অহেতুক ঘুরিয়ে বলে। এই জন্য এদের সঙ্গে ওর বনে না। তবে এই লোকটার কথাগুলো করুণ শোনাচ্ছে। মোটো সামনের দিকে ঝুঁকে বলে, পরিষ্কার করে বলেন না, আর একটু ভেঙে বলেন। আমি পানা-পুকুর বটতলার খ্যাপা মায়ের সেবক, দু’বেলা মায়ের সঙ্গে কথা বলি, ওর সব কথা বুঝি, কিন্তু লেখাপড়া জানা লোকেদের কথা বুঝি না।
আসলে ওটা অটিস্টিক বাচ্চাদের স্কুল। সমস্যাটার কথা শুনেছেন কি না জানি না, এটাকে ঠিক সমস্যা বলা উচিত কি না, জানি না। এর কোনও বাংলা হয় না, যেমন চেয়ার-টেবিলের বাংলা হয় না। সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ বাচ্চার অটিজম থাকে, না, না, এটা কোনও রোগ না, একটা অবস্থা। আলাদা একটা মানসিক অবস্থান। কারও কারও থাকে আর কী! যেমন আমার মেয়েটার আছে, আমাদের একটাই মেয়ে...। লোকটার গলা কেঁপে উঠল।
মোটো কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। লোকটা যেন নিজের তাগিদেই বলতে থাকে, আপনি হয়তো ভাবছেন সমস্যাটা গুরুতর। না, না, তেমন কিছু না, সব বাচ্চাই যে স্বাভাবিক ছাঁচে ফেলা হবে, তার কী মানে আছে। আপনি কখনও কুমোর পাড়ায় গেছেন?
মোটো বড় গলা করে বলে, গিয়েছি মানে? কুমোর পাড়াতেই আমার জন্ম। লোকটা মাথা নিচু করে বলতে থাকে, আমাদের সবার জন্মই কুমোর পাড়ায়। আমার কী মনে হয় জানেন, এ পৃথিবীর সব কিছুর পেছনে যদি আদৌ কোনও ঈশ্বর থেকে থাকেন, তিনি এক অক্লান্ত কুমোর, সামনে চাকা ঘুরে যাচ্ছে, চাকের ভেতর কাদা পাক খাচ্ছে, দু’হাতের প্যাঁচে তিনি নানান নিখুঁত, নিটোল, সুষম সব পাত্র তুলে আনছেন। যে যাই বলুক সারা দিন একঘেয়ে কাজ করতে করতে তারও ক্লান্তি আসে, মাথা টনটন করে, হাত অবশ হয়ে আসে, পেশিতে টান ধরে বা গৃহস্থালির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে কোনও কোনও মুহূর্তে মনোযোগ সরে যায়। তখনই জন্ম নেয় যত অসমাঙ্গ ফুল, ফল, বীজ, জীবজন্তু আর এই সব আলাদা শিশুরা।
মোটো থম মেরে রয়েছে। লোকটা বলে চলে, সন্তান যখন জন্ম দিয়েছি, তাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে লোভনীয় এই মানব জন্মের স্বাদ নিতে শেখার সুযোগ করে দিয়ে যেতে হবে, কী বলুন? স্বার্থপরের মতো নিজের পাওয়া না পাওয়া নিয়ে ভাবলে চলবে! তবে এক দিক থেকে ভালই হয়েছে। আমার মেয়েকে আর দশটা নর্মাল ছেলেমেয়ের মতো বাবা-মা’র প্রত্যাশার চাপ সহ্য করতে হবে না, ওকে কেউ মাথার দিব্যি দিয়ে বসবে না যে, তোকে সফল হতেই হবে। ওর জীবন, ওর নিজের জীবন, সেখানে ও বাঁচুক না যেমন করে খুশি। লোকটার উদাসীন কণ্ঠস্বর আটকে গেল।
মোটোর মুখটা দেখে মনে হচ্ছে শৌখিন শহুরে ড্রইংরুমের দেওয়ালে টাঙানো ছৌ নাচের চোখ বড় বড় কাগুজে মুখোশ। লোকটা আন্তরিক গলায় বলল, আপনি হয়তো ভাবছেন, এ সব কথা আপনার মতো অপরিচিত লোককে কেন বলছি, আসলে কথাগুলো আপনাকে বলছি না নিজেকে বলছি, জানি না। প্রত্যেক দিন কথাগুলো নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করি, কিন্তু বোঝাতে পারি কি? জানি না। প্রত্যেক দিন মনকে বলি মেনে নিতে শেখো, কিন্তু মেনে নেওয়া অতটা সহজ না। তবু চেষ্টা তো চালাতেই হবে, কী বলুন।
নিঃশব্দে কখন স্কুল ছুটি হয়ে গেছে ওরা দু’জনেই বুঝতে পারেনি। মেয়েটাকে নিয়ে ভদ্রলোকের স্ত্রী এসে দাঁড়িয়েছে ছাতিমতলায়। মোটো বাচ্চাটার দিকে তাকায়, খুব জোর ন’দশ বছরের মেয়েটা অন্যমনস্ক তেরছা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, দৃষ্টিতে আপাত কোনও লক্ষ্য নেই। ঠোঁটে তিরতির করছে অদ্ভুত একটা হাসি, কাঁপছে কিন্তু নড়ছে না। যেন নিজের ভেতরে বুঁদ হয়ে আছে। মোটো ঘুরে গিয়ে ওর চোখের ওপর তাকায়। মেয়েটা চোখ সরিয়ে নেয়। যত বার ওর চোখে চোখ রাখা যাচ্ছে, তত বার চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। মুখে বিরক্তির চিহ্ন নেই, হাসিটা পাল্টাচ্ছে না। মেয়েটা যেন তাকে তোয়াক্কাই করছে না, সে তার স্বভাবসিদ্ধ কটমটে চোখে তাকায়, মেয়েটা তবু হাসছে। ভয়ের চিহ্ন মাত্র নেই মুখে।
মোটো ওর মার্কা মারা ঘড়ঘড়ে গলায় চোখ পাকিয়ে বলে, অ্যাই, আমায় চিনিস? জানিস মোটোখোকো বাচ্চাদের নিয়ে গিয়ে কী করে? কোথায় গেল আমার ঝোলাটা? মেয়েটা একই রকম অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে আছে। সামান্য হেলিয়ে মাথাটা নাড়িয়ে যাচ্ছে। অ্যাই শোন, বল তোর নাম কী? এ দিকে তাকা, বল তোর নাম কী?
মোটোর এত দিনের ভয়ানক মূর্তি যে খামোকা এ ভাবে অকেজো হয়ে উঠবে, সেটা সে নিজেও আঁচ করতে পারেনি। ভয়হীন মুখটা দেখে সে আপাদমস্তক ঘাবড়ে গেছে। মেয়েটার মা আদুরে গলায় বলে, জেঠুকে তোমার নাম বলে দাও, বলো তোমার নাম কী? বলো আমার নাম রূপকথা। বেশ মিনিট আধেক পরেও মেয়েটার ভেতর থেকে কোনও শব্দ উঠে আসেনি। ও এখন মুডে নেই, আবার কখনও এক বারের চেষ্টাতেই নাম বলে। মেয়েটা এক মনে বাবার দেওয়া স্কুটারের চাবির রিংটা বার বার আঙুল দিয়ে ঘুরিয়ে যাচ্ছে। ওরা চলে যাওয়ার সময় মোটোর প্রশ্নের উত্তরে বলে গিয়েছিল আবার পরশু আসবে।
পরশু দিন মানে সে-দিন বুধবার স্কুল ছুটির পর মোটো কোত্থেকে ঠিক হাজির। কিছুটা ইতস্তত করার পর ঝপ করে বলল ও মেয়েটাকে কোলে নিতে চায়। বাবা-মা বারণ করেনি। প্রতিবন্ধী সন্তানের বাপ মায়ের ছেলেধরার ভয় বোধ হয় একটু কমই থাকে। মোটোখোকোর মোটা মোটা চুলদাড়িগুলোর মধ্যে আঙুল চালিয়ে অকুতোভয় মেয়েটা দিব্যি খেলা জুড়েছে। দৃশ্যটা দেখলে মোটোর এলাকার বাচ্চারা সব তাজ্জব বনে যেত। মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা হল! এত ভাল শেষ কবে লেগেছিল মনে পড়ে না। এত আনন্দ সে তার শরীরের ভিতর কী করে রাখবে?
কিন্তু হঠাৎ মোটো আনমনা হয়ে গেল। মুখে মেঘলা নেমে এল। মেয়েটাকে আস্তে করে নামিয়ে রেখে আচমকা সে হাঁটতে শুরু করল পাশের গলিটা দিয়ে। অনেক দিন পর আজ মনের তলা থেকে একটা কচি তুলতুলে মেয়ের মুখ ভেসে উঠেছে। তার আর বুনির একমাত্র মেয়ে বুল্টির মুখটা। এত দিনে তার তেরো-চোদ্দো বছর বয়স হয়ে যাওয়ার কথা, মেয়েটা আদৌ বেঁচে আছে তো? বুনির মতিগতি ভাল ছিল না, কে জানে মেয়েটাকে বেচে দিয়েছে কিনা। মেয়েটা কি কোনও দুরারোগ্য রোগে অনেক দিনই হল আর নেই বা লম্পট বরের হাতে পড়ে অভিশপ্ত জীবন কাটাচ্ছে, নাকি পাচার হয়ে গেছে মধ্যপ্রাচ্যের কালো দুনিয়ায়। এখন দেখা হলে মেয়ে ও বাবা একে অপরকে চিনতেই পারবে না।
মাঝে মাঝেই ঘুরে ফিরে সেই দিনটার কথা মনে আসে যেদিন বেলা ন’টা নাগাদ বেঘোর ঘুম থেকে উঠে সে উদ্ধার করেছিল বুনি তাদের একমাত্র মেয়েটা আর ঘরের যাবতীয় দামি জিনিসপত্র নিয়ে কালো মিস্ত্রির সঙ্গে ভেগেছে। বিয়েতে শ্বশুরবাড়ি থেকে বরকে কাচ বসানো একটা সোনার আংটি দিয়েছিল। ওর শালা ন্যাড়া বিষ্টু ওকে বুঝিয়েছিল ওই কাচের টুকরোটা হিরে, বম্বে থেকে আনিয়েছে। অনেক দিন পর্যন্ত কথাটা বিশ্বাস করেছিল মোটো। সকালের আলোয় কত দিন ওটাকে ধরে নির্জনে সে সূর্যের আলোকে সাত রঙে ভেঙে দিয়েছে। আংটিটা গোপন জায়গায় লুকোনো থাকত, কিন্তু যাওয়ার সময় বুনি ওটাকেও নিয়ে গিয়েছিল।
মোটোর মাথার ভেতর শুকনো পাতা ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু এই সব পাতা মাড়িয়ে গেলে মচমচ শব্দ হয় না।
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|