|
|
|
|
সে যতই কালো হোক |
কালো মোটা ফ্রেম-এর চশমা বললেই কী কী মনে পড়ে? চিরতরের ‘মাস্টারদা’,
প্রতিষ্ঠানবিরোধী আঁতেল, কমল মিত্র, ক্যাবলা জিনিয়াস আর...ফ্যাশন ফ্ল্যাশব্যাক। অনুরাগ রশিদ |
কত বাঙালি প্রেমিক স্রেফ চোখে চোখ রাখতে পারল না বলে স্বপ্নের রাজকন্যে মিস হয়ে গেল। না না রাজকন্যের নয়, তাঁর বাবার। কারণ বাবা’রা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছবি বিশ্বাস, বিকাশ রায় বা কমল মিত্র হতেন কিনা! তা-ও একটা আধুলি চান্স নেওয়া যেত, যদি তাঁদের চোখ-ভর্তি ওই মোটা কালো ফ্রেমের চশমা না থাকত। ওই কালো ফ্রেম এক জন গম্ভীর হোমো-স্যাপিয়েনকে মুহূর্তেই কেমন যেন গা ছমছমে করে তুলত। আর সে দাপটেই তো, সারি সারি ফোকাস সমূলে বিনাশ। অতএব প্যাথোজ নামে পাড়ায়...
খানিক ভ্রু কুঁচকোলেই পরিষ্কার দেখবেন, এ গোলার্ধ টু অন্য, কোথাও মোটা কালো ফ্রেম চশমাকে কোলাকুলি রেঞ্জে নেওয়া হয়নি। একটা দূরত্ব বজায় থেকেছে বরাবর। একটা অস্বস্তি। ইতস্তত ভাব। মোদ্দা কথা, মোটা কালো ফ্রেমদের সঙ্গে দিলখোলা আড্ডা জমে ওঠেনি কখনও। জমলেও দেখুনগে যান সেই একেবারে ছবির সেকেন্ড হাফ-এ। ধরেই নেওয়া হয়েছে ওঁরা আলাদা। ওঁদের জীবনে ফ্রেশ হাওয়া, লুকিয়ে আচার খাওয়া, ভাসানে নাচতে যাওয়া পাপ পর্যায়ের। যেন এক এক জন সদ্য কাচা টেবলক্লথ। জ্যাঠামশাইও। যাঁর ডিসিপ্লিন্ড নাকের তলা দিয়ে আচ্ছা আচ্ছা ফাটা কেষ্টও গলতে পারেনি। ওঁরা প্রত্যেকেই দুর্ধর্ষ ফিজিক্স বোঝেন, ম্যাজিকের মতো দাবা খেলেন, কালোজিরে মৌরি দিয়ে মহাজাগতিক মাগুর রাঁধতে পারেন আর হ্যাঁ বাধ্যতামূলক ভাবে পাড়ার ‘মাস্টারদা’ হয়েই রয়ে যান। শিখরে উঠতে পারেন না। যে কোনও কারণেই হোক। তাই প্রথম দেখার ভয় কাটলে, এক সময় আমরা কালো ফ্রেমকে মায়ার চোখেও দেখতে থাকি। মনে হয়, বাজারের ব্যাগটা একটু বয়ে দিই না, কী আর লেট হব!
ফেরার পথে আবার দেখা পাই কালো ফ্রেম-এর। পিছন থেকে রক-এর ভাইসকল বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করেই চলেছে। কালো ফ্রেম সব বুঝেও আঁচল ও ভ্যানিটি ব্যাগ সামলে ভিড় মিনিতে মিশে যায়। শোনেননি বাবার কারখানায় লক আউট আর বোনের সম্বন্ধ দেখা চলছে আর ভাইয়ের স্কুলের মাইনে আবার বাড়ল... ওই কালো ফ্রেম না থাকলে উঠোনটা আরও কত যে শুকনো দেখাত... তবে মোটেও ভাববেন না, বাংলা ছবিতে (সমাজের ছবিতেও) কালো ফ্রেম শুধুই সয়ে যাওয়া পার্টি। সত্তর যখন প্রাণ খুলে নামছে বাংলা বাজারে, ঠিক সেই সময়ে দেখা গেল কালো ফ্রেমদের ঠোঁটে ঠোঁটে ঘুরছে একটাই লাইন, ‘আমি মিস ক্যালকাটা...’ সে কালো ফ্রেম ভাল করেই জানেন যে তাঁকে খুব সে দেখা হচ্ছে, তাঁর স্লিভলেস ব্লাউজ, অনেকটা খোলা পিঠ, চিবুকের তিল, উঁচু চুলের খোঁপা, মোটা কালো ফ্রেম-এর চশমা, সব সব। এই কালো ফ্রেম টানতে জানে নিজের কাছে। তাঁর নার্ভে তো বইছে তখন চাপা এক রাশ যৌন জোয়ার। আর নার্ভাস লাগছে পাশের পুরুষের। আসলে এ ভাবে অভ্যেস নেই তো! |
|
পশ্চিমে কালো ফ্রেমকে দেখা গিয়েছে দু’রকম রূপে। প্রথম রূপ অবশ্যই তাবড় ইন্টেলেকচুয়াল, যে দেরিদা শপেনআওয়ার গুলে খেয়েছে। সে অ্যানালিস্ট, অ্যাকাডেমিক, হয়তো প্রতিষ্ঠানবিরোধীও। আর অন্য ফুট-এ সেই সব কালো ফ্রেম, যাঁরা কেমন যেন বেঢপ, খাপছাড়া, যাঁদের পিছনের বেঞ্চ থেকে ক্রমাগত কাগজের ঢিল খেতে হয়, যাঁদের প্যান্ট মোক্ষম জায়গায় ভিজিয়ে দিয়ে একটা গোটা ব্যাচ হেসে গড়িয়ে পড়ে, হাসে না শুধু এক জনই, যে সবচেয়ে সুন্দরী। কিন্তু কালো ফ্রেম যখন বোঝে, সেটা সিমপ্যাথি মাত্র, তখন সে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ির গ্যারাজ-এ বসে রাগে দুঃখে একটা কোনও অলৌকিক মেশিন আবিষ্কার করে ফেলে। হলিউড-এর বড় সুবিধে, ভবিষ্যতের ব্লকবাস্টার রেডি।
এখন তো সব কিছুই কথায় কথায় ‘রেট্রো’ হয়ে যায়। কালো ফ্রেমও হয়েছে তাই। নতুন নতুন লোক ওতে চোখ গলিয়ে চলতি অভ্যেস ভাঙতে উদ্যোগী মাত্র। খেয়ালই করে না কেউ, মোটা কালো ফ্রেম আর শুধু ফ্যাশন বোঝায় না, বোঝায় একটা ইতিহাস হয়ে যাওয়া বেলাকে চিনে নেওয়ার কায়দা। সেই বেলায় ফিরতে, ঠিক তেমনটা হয়ে যেতে চাইলে, কালো ফ্রেম লাগবেই। |
|
|
|
|
|