|
|
|
|
কেবল আছি বলেই |
আমার কিছু অধিকার পাওনা। মানুষ বলেই। রাষ্ট্রপুঞ্জ বলেছে। তা হলে
যারা বঞ্চিত, তাদের কত পাওনা মানবাধিকার? সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় |
বছরের এই শেষ দিকটা ভারী মিলমিশ মতো। এক দিকে শীতকালের বরাদ্দ আনন্দ ঝপাঝপ পজিশন নেয়, শীতের সন্ধের মন-খারাপ সঙ্গী হয়, লেপের আদর ভারী চমৎকার লাগে, বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান মন-খাতা-কম্পিউটার পেরিয়ে হাওড়া-দমদম-বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগোতে থাকে, পিকনিকের কমলালেবু নিজেদের আরও খানিক কমলা করে মেজে নেয়, আবার ও দিকে এই সময়েই আমরা দিন পনেরো পালন করি হিংসার বিরুদ্ধে আর প্রাপ্য অধিকারের জন্য। ভোপালের গ্যাস দুর্ঘটনায় আক্রান্ত মানুষদের অধিকারের লড়াই, নারীর বিরুদ্ধে হিংসা বন্ধ হওয়ার লড়াই, সমকামীদের অধিকার, শরণাগতের অধিকার, আরও অনেক রকমের অধিকারের জন্য মানবাধিকার পক্ষ আর নারীর বিরুদ্ধে হিংসা বন্ধ হওয়ার পক্ষ। |
|
তার মানে আনন্দ, দুঃখ, রাগ, হতাশা সব একসঙ্গেই বসবাস করে। যেমন করে সারা বছরটাই। তবে এখন নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার কী? এই সময় মানবাধিকার না চাইলে, হিংসার বিরুদ্ধে গলা না ফাটালে কি তার গুরুত্ব কমে যায়? একেবারেই না। কিন্তু ধরাতলে হইহই করে বেঁচে আছি, এর সেলিব্রেশন যেমন জন্মদিনের দিনটায় লুকিয়ে থাকে, তেমনি সব চাহিদা, সব অধিকার, সব ন্যায়, সব অন্যায় মনে করারও নিজস্ব নিজস্ব দিন আছে। দিনগুলো না থাকলে তাদের গুরুত্ব হারিয়ে যায় না, আবার দিনগুলো থাকলে আলাদা করে সামনের সারির আসনও পায় না। তবু মনে করতে হয়। নিজেকে মনে করাতে হয়। এক বার করে ঝালিয়ে নিতে হয় বইকি। যেমন ঝালিয়ে নিতে হয় আমি এই পৃথিবীতে জন্মেছি, এত আলো-হাওয়া-রোদ্দুর-বৃষ্টি-উথালপাথাল-প্রেম-বিরহ-চাকরি-টাকা-ঈর্ষা সব মিলিয়ে একটা মনুষ্যজীবন পেয়ে গিয়েছি এটা কি কম প্রাপ্তি? অথচ আমরা নিরন্তর সে কথা ভুলে সারা ক্ষণ নিজের না পাওয়া, নিজের ব্যর্থতা, অন্যের সাফল্য, এ সব বড় করে দেখি। বললেই বলবেন, আমি কি মহা হনু আর কী এমন নতুন কথা বলছি! এ কথা তো সবাই জানে। অন্তত জীবন-ম্যানেজমেন্ট-এর গুরুদেবরা তো সে কথা বলে বলে আমাদের জীবন খানিক বদলেও দিলেন।
|
তাঁদের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে জীবনের এ সব ছোটখাটো ছুটপুট ভুলে জোরে শ্বাস, অযথা খুশির কারণ হিসেবে বাড়িতে পার্টি থ্রো, বিবাহবার্ষিকীতে বেড়ানোর প্যাকেজ উপহার দেওয়া এ সব কি আমরা নিজের প্রতি যত্নের, নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবার এক একটা বড় উপাদান বলে মন থেকে মেনে নিইনি? নিয়েছি তো। এবং কী খুশি যে হয়েছি সে তো আপনিও ভালই জানেন। কিন্তু সে সব অন্যের শর্তে, অন্যের বলে দেওয়া পথে।
নিজেকে কতটা ভালবেসেছি? নিজের জন্য কত ক্ষণ বেঁচেছি? কখনও এটা ভেবে দেখেছি যে আরে! আমি তো মানুষ না হয়ে জন্মাতেই পারতাম। অন্য কোনও প্রাণী! এই আশ্চর্য একটা প্রাণী যার নাম কিনা ‘মানুষ’ আমি ঠিক সেই প্রজাতিরই অঙ্গ। আমার হাত-পা আছে, বোধ আছে, খিদে পায়, সাজতে ভাল লাগে, আমি অঙ্ক করতে পারি, আমার বুদ্ধি আছে, আমি সত্য-মিথ্যের মতো সূক্ষ্ম জিনিসের বিচার করতে পারি! এটা আশ্চর্য নয়? কেন পৃথিবীই এমন একটা গ্রহ হল সৌরজগতের মধ্যে, যার মধ্যে জল থাকল, প্রাণের সঞ্চার হল, বিবর্তন হল আর আমি থাকলাম। আমার জীবনটা উপভোগ করলাম! এ সব কথা বহু আগে বহু মানুষজন বলে গিয়েছেন, আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে ভেবে গিয়েছেন। তবু আপনি নিজের জন্য ভেবে দেখবেন, মনে হবে এ সবই কেবলমাত্র আপনার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠেছে। কেবল আপনি জন্মাবেন বলে, আপনি শ্বাস নেবেন বলে, আপনি একটা জীবন যাপন করবেন বলে। আর আমরা প্রত্যেকে কী হেলায় সেটা ভুলে যাই, তাই না? কেবল মানুষ হয়ে জন্মাবার জন্যই যে এত কিছু প্রাপ্তি, সেটা আমাদের মানুষ-বুদ্ধির দাপটে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। উঠে এসেছে জটিল কিছু সমীকরণ, যা সলভ করতে না পারলে জীবনটা ফাঁকি হয়ে যায়। জানেন তো, রাষ্ট্রপুঞ্জ কী বলেছে? বলেছে, কেবল মানুষ হয়ে জন্মাবার জন্যই আমাদের কিছু অধিকার বরাদ্দ থাকে জন্মগত, আর সেটাই মানবাধিকার। আর আমরা কিনা ভাবি, বঞ্চিত না হলে কোনও কিছুতে অধিকার জন্মায় না, অধিকার সব সময় ছিনিয়ে নিতে হয়, গলা ফাটাতে হয়। নিজেরা নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নই, কমফর্টেবল নই। যা কিছু বিচার করি অন্যের সাপেক্ষে। নিজেকে মর্যাদা দেওয়ার রেওয়াজ আমাদের শেখানো হয় না।
তা হলে? আজকের দিনটা কেবল এই বলেই উদ্যাপন করা যায় তো, যে মানুষ হয়ে জন্মেছি, কিছু অধিকার আমার বরাদ্দ। তবে সে জন্য দায়িত্ব নিতে হয়। নিজেকে ভালবাসার দায়িত্ব, নিজের অস্তিত্বকে নিজের মাপকাঠিতে বিচার করার দায়িত্ব। আমরা যারা কেন্দ্রের বঞ্চনা আর আমেরিকার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কোনও কিছুতে তেমন ভাবে বঞ্চিত নই, তাদেরই কত মানবাধিকার রয়েছে, সে সব তো ভেবে দেখতে হবে!
আর যাঁরা সত্যিকারের বঞ্চিত, তাঁদের কী অবস্থা? যাঁদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চলছে, যাঁরা পারিবারিক হিংসার শিকার হচ্ছেন, হিজড়ে বলে যাঁরা প্রান্তিক, অন্ত্যেবাসী, যাঁরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিত? তাঁদের মানবাধিকারের জন্য তো লড়তেই হবে, গলা ফাটাতেই হবে, আন্দোলন চালাতেই হবে। কিন্তু নিজেকে ভুলে গিয়ে নয়। বরং নিজের প্রতি যত সম্মান করতে পারব, নিজের যত্ন যত বেশি করতে পারব, নিজের ৩৬৫X২৪X৭ অধিকারগুলো অন্যদের কাছে, এবং নিজের কাছেও, যত জোর দিয়ে দাবি করতে পারব, বঞ্চিতের জন্যে, নির্যাতিতের জন্যে, প্রান্তিকের জন্যে আমাদের লড়াইটাও ততই জোরদার হবে, নিজের মধ্যে নতুন এনার্জি নিয়ে তাদের মানবাধিকার ফেরত দেওয়ার লড়াইয়ে নামতে পারব। তাই না? |
|
|
|
|
|