নজির গড়ল পঞ্চাননতলা
ত্রাতা হলেন ‘দূরের’ মানুষেরাই
‘অভিজাত’ হাসপাতালের কেতাদুরস্ত আবহের পাশে ওঁরা যেন কিছুটা বেমানান। যে জন্য কিছুটা ‘দূরের মানুষ’ই হয়ে থাকতেন ঢাকুরিয়ার এএমআরআইয়ের গা ঘেঁষে থাকা ওই বস্তিবাসীরা। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের ওঁদের সম্পর্ক যে খুব ‘মধুর’ ছিল, তা-ও হলফ করে বলা কঠিন।
কিন্তু একটা রাত সব হিসেব উল্টে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার মাঝরাতের মারণ-কাণ্ডের পরে হাসপাতালের জীবিত রোগীর পরিজনদের কাছে পঞ্চাননতলা বস্তির ওই তরুণ-যুবকরাই ‘মসিহা।’ বস্তিবাসীদেরও আক্ষেপের শেষ নেই। ওঁরা বার বার বলছেন, ‘অন্তত ঘণ্টাখানেক আগে ঢুকতে পারলে আরও অন্তত পঞ্চাশটা প্রাণ হয়তো বাঁচানো যেত!’ কী ঘটেছিল?
বস্তির ছেলেরা জানাচ্ছে, রাত তখন প্রায় আড়াইটে। হঠাৎ দেখা যায়, বিষ-ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া হাসপাতালের নিষ্প্রদীপ কেবিনগুলোর কাচের জানলা ভাঙার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন রোগীরা। শোনা যায় ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ আর্তনাদ।
দেরি করেননি ওঁরা। মুমূর্ষুদের উদ্ধার করতে পঞ্চাননতলা বস্তির প্রায় শ’দুয়েক বাসিন্দা দৌড়ে গিয়েছিলেন হাসপাতালের সামনে। কিন্তু তালাবন্ধ লোহার গেটের বাইরে ওঁদের থমকে যেতে হয়। সেখানে দাঁড়িয়েই অসহায় চোখে দেখতে থাকেন মৃত্যুর ধোঁয়া কী ভাবে গ্রাস করছে রোগীদের। শোনেন বাঁচার জন্য তাঁদের আকুতি।
যা শুনে শেষ পর্যন্ত তাঁরা আর স্থির থাকতে পারেননি। পাঁচিল টপকেই হাসপাতালের ভিতরে ঢুকে পড়েন বস্তির কয়েক জন। গেটে মোতায়েন নিরাপত্তাকর্মীদের ধাক্কা মেরে সরিয়ে বাকিদের ভিতরে যাওয়ার রাস্তা করে দেন তাঁরাই।
কিন্তু ততক্ষণে যে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে! কম করে ঘণ্টাখানেক। যার মাসুল দিতে হয়েছে অনেকগুলো প্রাণকে।
শুক্রবার সকালে সেই আফসোসই স্পষ্ট বাসু দামকয়াল-রাজু ভাণ্ডারী-রমাপদ পুরকাইত-রণজিৎ দাশগুপ্তদের গলায়। যাঁদের অভিযোগ, আগুন লেগেছে টের পেয়েই তাঁরা হাসপাতালের সামনে পৌঁছে গিয়েছিলেন। অথচ হাসপাতালের নিরাপত্তাকর্মীরা মূল ফটকে সকলকে আটকে দেন। বাসুবাবুর কথায়, “সিকিউরিটি বলল, সামান্য ব্যাপার, আমরাই সামলে নেব। এখানে বেশি ঝামেলা না-করে আপনারা চলে যান।”
বাসুবাবুরা অবশ্য কেউ ফিরে যাননি। বরং পিছনের পাঁচিল ডিঙিয়ে হাসপাতাল চত্বরে নেমে পড়েন অনেকে। রক্ষীরা বাধা দিতে এলে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেন, খুলে দেন মেন গেট। তা দিয়ে ঢুকে পড়েন বাকিরা। তবে হাসপাতালের সামনের চত্বর ততক্ষণে বিষাক্ত গ্যাসে ভরে গিয়েছে।
তার পরে কী করলেন?
বাসুবাবু বলেন, “চার দিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। উপরে শুধু বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার। টর্চ, মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে কয়েক জন সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকি। এত ধোঁয়া যে, হাঁটা যাচ্ছিল না। শেষে হামাগুড়ি দিতে হল। মাথার উপরে গলগলিয়ে বেরোচ্ছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। ও ভাবেই তিনতলায় পৌঁছোলাম।” অন্য ছেলেরা তখন বাইরে থেকে ইট ছুঁড়ে বিভিন্ন তলার পুরু কাচের জানালা ভাঙার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যাতে জমে থাকা ধোঁয়ার বিষ বেরিয়ে যায়। দমকলের সিঁড়ি তখনও আসেনি। তাই বাইরে থেকে উপরে পৌঁছানোর জন্য বস্তির ছেলেরাই নিয়ে আসেন বাঁশের ভারা।
ওঁরা জানাচ্ছেন, ধোঁয়ায় ভরে থাকা কয়েকটা ওয়ার্ডে প্রথমে ঢোকাই যাচ্ছিল না। তাই হাতের কাছে শক্ত যা কিছু পেয়েছেন, তা দিয়েই জানলার কাচ ভাঙতে থাকেন। আপৎকালীন নির্গমন-পথও ছিল ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ। রণজিৎবাবু বলেন, “বিছানার চাদর, বালিশের কভার, তোয়ালে যে যা পেয়েছি, তা-ই নাকে বেঁধে ভিতরে ঢুকেছি। ঝাঁঝালো গন্ধের সঙ্গে প্রচণ্ড তাপ। চোখ-মুখ জ্বলছিল। কাচ ভাঙা জানালা দিয়ে মাঝে মধ্যে মুখ বাড়িয়ে শ্বাস নিয়েছি।”
কিছুক্ষণ পরে দু’-তিন-চারতলায় পৌঁছানোর রাস্তা খুঁজে পান রাজুবাবু-বাসুবাবুরা। কোনও মতে ঢোকেন একটা ওয়ার্ডে। রাজুবাবু বলেন, “ওখানে দেখি, মহিলা-পুরুষ মিলিয়ে জনা পনেরো রোগী। বেশির ভাগই বয়স্ক। কারও-কারও সদ্য অপারেশন হয়েছে। আমাদের দেখেই হেল্প মি, বাঁচান-বাঁচান বলে চিৎকার শুরু করলেন।”
হাসপাতালের কোনও কর্মীকে আশপাশে পাওয়া যায়নি। আগত্যা রাজুবাবুরাই অপটু হাতে রোগীদের শরীরে গাঁথা স্যালাইন বা ওষুধের নল, অন্যান্য যন্ত্র খুলতে শুরু করেন। রাজুবাবুর বর্ণনায়, “এক জনের স্যালাইন খুলছি, পাশের বেডগুলো থেকে চার-পাঁচ জন মাটিতে ঘষটে-ঘষটে এসে আমাদের হাত-পা চেপে ধরছেন। ওঁদের কত বার বললাম, আমরা তো সবাইকেই বাঁচাতে এসেছি! কে শোনে!”
এর পরে রোগীদের নামিয়ে আনা শুরু হয়। ততক্ষণে দমকল, পুলিশ এসে গিয়েছে। মৃতের সংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছে। উদ্ধারকারীদের অনেকেই বলেছেন, হাসপাতালে ‘সিল’ করা জানলার বদলে ‘স্লাইডিং’ কাচ থাকলে মৃত্যু কিছুটা হলেও কমানো যেত।
‘অভিজাত’ ওই হাসপাতালে কখনও ঢোকার সুযোগ হয়নি ওঁদের। সেখানকারই রোগীদের প্রাণরক্ষার জন্য পুলিশ-দমকলের সঙ্গে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে লড়ে দৃষ্টান্ত গড়ল পঞ্চাননতলা বস্তি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.