|
|
|
|
শূন্যতা |
যিনি বেঁচে, তিনি কি আমার লোক, উৎকণ্ঠা আত্মীয়দের |
সাবেরী প্রামাণিক ও শান্তনু ঘোষ • কলকাতা |
একসঙ্গে অনেকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন রিসেপশনে। জানতে চাইছেন, হাসপাতালে ভর্তি আত্মীয়ের কোনও ক্ষতি হয়নি তো! কিন্তু রিসেপশনেও সেই খবর পাননি সবাই। কারণ এএমআরআই হাসপাতালের কর্মীদের কাছে আগুনে মৃতদের বিস্তারিত তথ্য ছিল না। আতঙ্ক, উদ্বেগ আর অসহায়তাকে সঙ্গী করে রোগীর আত্মীয়েরা শুধু অপেক্ষা করেছেন নিজের মানুষের খবর জানতে।
হাসপাতালে আগুন লেগে তা যে ভয়াবহ আকার নিয়েছে, টেলিভিশনের দৌলতে ভোরেই সে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। শুক্রবার সকাল তখন পৌনে সাতটা। এএমআরআই হাসপাতালে রিসেপশনের চেয়ারে বসে আছেন ইউনিফর্ম পরা রোগীরা। আর রিসেপশন ডেস্কের সামনে প্রচুর লোকের ভিড়। সকলেই নিজের মানুষের খবর জানতে চাইছেন। কিন্তু হদিস মিলছে না।
এরই মধ্যে অ্যানেক্স-২ ভবন (যেখানে আগুন লাগে) থেকে উদ্ধার করা রোগীদের একে একে নিয়ে আসা হচ্ছে রিসেপশনে। তাঁদের দেখে দৌড়ে যাচ্ছেন রিসেপশনে ভিড় করে দাঁড়ানো মানুষগুলো। স্ট্রেচারে শোয়ানো ব্যক্তিটি যাঁর আত্মীয়, তিনি কিছুটা আশ্বস্ত হচ্ছেন। যাঁরা সেই মুখটা খুঁজছেন না, তাঁরা আবার এসে ভিড় করছেন রিসেপশনে।
কখনও অনুরোধ করে, কখনও রেগে গিয়ে নিজের মানুষের খবর জানতে চেয়েছেন তাঁরা। কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হওয়ার পরেও আপনজনের খবর পাননি অনেকে। যেমন সুরিন্দর বর্মা। তাঁর স্ত্রী সুষমা বর্মার এ দিনই ব্রেন টিউমার অপারেশন হওয়ার কথা ছিল। সুষমা ভর্তি ছিলেন অ্যানেক্স-২ ভবনের পাঁচতলায়। শুক্রবার ১১টা নাগাদও স্ত্রীর খবর জানতে না পেরে দিশেহারা ভাবে
ঘুরছিলেন সুরিন্দর।
রিসেপশনে বসে থাকা রোগীদের জিজ্ঞাসা করে এবং অ্যানেক্স-২ থেকে উদ্ধার করে আনা কিছু রোগীর নাম সংগ্রহ করে এ দিন সকাল প্রায় সাড়ে সাতটা নাগাদ হাসপাতালের রিসেপশনে দু’টি তালিকা ঝোলানো হয়। ওই একবারই। তার পরেও বহু রোগীকে সরানো হয়েছে। কিন্তু নতুন কোনও তালিকা ঝোলানো হয়নি। তার উপরে তালিকায় অনেক নাম পুরো লেখা ছিল না। এতে হয়রানি বেড়েছে রোগীর আত্মীয়দের।
ভোর থেকে অপেক্ষা করে বেলা ক্রমশ বাড়তে থাকার পরেও নিজের লোকের খবর না পেয়ে একসময় আর ধৈর্য রাখতে পারেননি কোনও কোনও রোগীর আত্মীয়। বেলা সওয়া ন’টা নাগাদ রিসেপশনে ভাঙচুর চালানো হয়। সেখানে রাখা রেজিস্টার ও জরুরি কাগজপত্র ছুড়ে ফেলে বিক্ষোভ দেখান কয়েক জন। এর পরে দীর্ঘক্ষণ হাসপাতালের কর্মীদের দেখা মেলেনি। ফলে নিরাপদে সরিয়ে আনা গিয়েছে, এমন রোগীর তালিকায় পরিচিতের নাম খুঁজে পেয়েও আত্মীয়েরা বুঝতে পারেননি যে, হাসপাতালের কোন তলায়, কোন বিভাগে গেলে নিজের লোককে পাবেন তাঁরা। দীর্ঘক্ষণ হাসপাতালের কর্মীদের দেখা না পেয়ে আত্মীয়েরা অপরিচিত সাংবাদিকের কাছেই ‘বেড’ নম্বর উল্লেখ করে রোগীর খোঁজ করেছেন।
কলকাতার মানুষ তো বটেই, অন্যান্য জেলার, এমনকী অন্য রাজ্য থেকেও অনেকে এএমআরআইয়ে আসেন চিকিৎসার জন্য। তাঁদের অনেকেরই আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ। কলকাতার অন্যতম নামী এই হাসপাতালে এমন দুর্ঘটনা এবং তার পরে হাসপাতালের কর্মীদের এই ‘অসহযোগিতা’য় তাঁরা ক্ষুব্ধ, বিস্মিত।
যেমন, বাগনানের চন্দন চক্রবর্তী। মা গায়ত্রীদেবীকে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করেছিলেন এএমআরআইয়ে। আগুন লাগার পরে বৃহস্পতিবার গভীর রাতেই গায়ত্রীদেবীকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন নার্স। কিন্তু তার পরে ওই রোগীর কী হল, সে খেয়াল ছিল না কারও। কখনও হাসপাতালের সিঁড়িতে বসে, কখনও এই ওয়ার্ড, ওই ওয়ার্ডে অসুস্থ শরীরে ঘুরে বেরিয়ে রাত কাটিয়েছেন প্রৌঢ়া। চন্দনবাবুর বক্তব্য, “অনেক কষ্ট করে টাকা জোগাড় করে কলকাতার নামী হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম মা’কে। এই পরিষেবা পাব বলে?”
হেমাটোলজি বিভাগে ভর্তি ছিলেন কৌশিক প্রামাণিক। আগুন লাগার খবর পেয়ে কোনও রকমে নীচে নেমে নিরাপদ দূরত্বে চলে আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু রাত কেটেছে গায়ত্রীদেবীর মতোই এখানে-ওখানে ঘুরে। ওই বিভাগেই ভর্তি ছিলেন সৌম্যজিৎ দাশগুপ্ত। তাঁর গলায় অস্ত্রোপচার হয়েছে। কথা বলতে পারছেন না। কোনও রকমে রিসেপশনে বসে কাটিয়েছেন বৃহস্পতিবার রাতটা।
এ দিনের ঘটনায় মেয়েকে হারিয়ে হাসপাতালের মেঝেয় শুয়ে কাঁদছিলেন প্রৌঢ় বাবা। তাঁর আক্ষেপ, “অসুস্থ মেয়েকে সারিয়ে তুলতে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। সেখানেই আগুন লেগে যে মেয়ে মারা যাবে, এটা কি দুঃস্বপ্নেও
ভাবা যায়!” এঁরা তো অন্তত নিজের মানুষের খোঁজটুকু পেয়েছেন। কিন্তু খবর না-পেয়ে অনেক রোগীর বাড়ির লোক হন্যে হয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন সল্টলেক ও মুকুন্দপুর এএমআরআই, এসএসকেএম-সহ অন্যান্য হাসপাতালে, যেখানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে উদ্ধার হওয়া রোগী ও আগুনে মৃতদের। যেমন, ধানবাদের মহম্মদ হাকিম। ঢাকুরিয়া থেকে গিয়েছিলেন সল্টলেক এএমআরআইয়ে। জেঠুর খোঁজ করতে। সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে জেঠুর হদিস না পেয়ে ফের গিয়েছেন ঢাকুরিয়ায়। নরেন্দ্রপুরের সীমা রায়ের বাড়ির লোক দিনভর হন্যে হয়ে খুঁজেছেন তাঁকে। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ তাঁরা জানতে পারেন, এসএসকেএমে পাওয়া গিয়েছে সীমাদেবীর মৃতদেহ।
আবার চিকিৎসার জন্য অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার রোগীদেরও প্রাথমিক ভাবে অন্য রকম সমস্যায় পড়তে হয়। এঁদের বেশির ভাগের কেস-হিস্ট্রি সংক্রান্ত ফাইল পুড়ে যাওয়ায় চিকিৎসকেরা প্রাথমিক ভাবে বুঝতে পারেননি, কী চিকিৎসা চলছিল। মুকুন্দপুরে এএমআরআই হাসপাতালের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্মাল্য দেবমান্না বলেন, “প্রাথমিক ভাবে আমাদের চিকিৎসকদের দিয়েই কাজ চালানো হয়েছে। পরে রোগীদের থেকে চিকিৎসকের নাম জেনে তাঁদের ডেকে পাঠিয়ে রোগীর ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেওয়া হয়েছে।”
স্থানান্তরিত এই রোগীদের কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না, তা দেখতে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নির্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর অফিসের দুই অফিসার অভিজিৎ লাটুয়া এবং শঙ্খশুভ্র
দাস ওই হাসপাতালগুলিতে গিয়ে রোগীদের সঙ্গে
কথা বলেন। |
|
|
|
|
|