সাইরেন বাজিয়ে একের পর এক অ্যাম্বুল্যান্স ঢুকছে, আর তার থেকে বার করে আনা হচ্ছে আগুনের তাপে কালো হয়ে যাওয়া মৃতদেহ। পরনে হাসপাতালের সবুজ স্ট্রাইপ পোশাক। অধিকাংশেরই হাতে বা পায়ে প্লাস্টার করা, কারও হাতে তখনও স্যালাইনের নল আটকে। নাক-মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে কালো জল। এসএসকেএম হাসপাতালের মর্গের সামনের বাতাসে ক্রমশ পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। উদভ্রান্তের মতো চারদিকে ছুটে বেড়াচ্ছেন মৃত ও নিখোঁজ রোগীদের স্বজন। ছুটছেন পুলিশ, হাসপাতাল কর্মী, ডাক্তার, মর্গের কর্মীরা। প্রায় রণক্ষেত্রে পরিণত সেই এলাকার একপাশে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্বাস্থ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের মুখ থেকে অস্ফুটে ছিটকে এল শব্দটা, “ডিজ্যাস্টার!”
আক্ষরিক অর্থেই ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে।’ কালো শুক্রবার। বেলা এগারোটা পার হতে না হতেই এএমআরআই হাসপাতাল থেকে এসএসকেএমের মর্গে স্রোতের মতো মৃতদেহ আসা শুরু। একই সঙ্গে শুরু নাজেহাল দশারও। কী ভাবে মৃতদেহ চিহ্নিত করা হবে, কেমন ভাবে তালিকা তৈরি করে তা পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে, নিখোঁজদের খোঁজ মিলবে কী ভাবে, এত মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার ট্রলি কী করে জোগাড় হবে, সব কিছু ঠিক করতেই দিশেহারা এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ। পরিস্থিতি সামাল দিতে খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য দফতর ও পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তারা সেখানে হাজির। প্রায় সারাদিন হাসপাতালে উপস্থিত থেকে গোটা ব্যবস্থা সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার চেষ্টা করেছেন মমতা। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে বিপর্যস্ত, ক্ষুব্ধ আত্মীয়-পরিজন আমরি হাসপাতাল ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর সামনেই তাঁদের ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। বিচার চেয়েছেন গাফিলতির।
বেলা সাড়ে এগারোটা। দৌড়তে দৌড়তে এসএসকেএমের মর্গ চত্বরে ঢুকলেন তিন তরুণ-তরুণী। তাঁদের মধ্যে জিনস-টপ পরা ফর্সা এক তরুণী একটানা চিৎকার করে বলে চলেছেন, “বাবাকে মেরে ফেলল, ওরা বাবাকে মেরে ফেলল। কোমর ভেঙেছিল বাবার। একদম ঠিক হয়ে উঠেছিল। আমি বললাম বুধবার বাড়ি নিয়ে যেতে। ওরা ছাড়ল না। পুড়িয়ে মারল আমার বাবাকে। শেষ করে দিল। আমি মা-কে কী বলব!” কাঁদতে কাঁদতে তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। বেলঘরিয়ার অলোক চৌধুরীর কালো হয়ে যাওয়া মৃতদেহ তখন মর্গে ঢুকে গিয়েছে। পৌঁছে গিয়েছেন স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, এসএসকেএমের অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্র-সহ একাধিক স্বাস্থ্যকর্তা। বিভ্রান্ত সুশান্তবাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন, “এত ক্ষণ হয়ে গেল এএমআরআই হাসপাতাল এখনও মৃত-আহতদের কোনও তালিকা পাঠাল না! ওদের নাকি ফ্যাক্স কাজ করছে না। ডিজগাস্টিং। বাইরে থেকে ফ্যাক্স করা যায় না! কোন হাসপাতালে আহতদের পাঠানো হল বুঝতে পারছি না। একের পর এক মানুষ নিখোঁজ আত্মীয়ের খোঁজ না-পেয়ে পিজি-তে আসছেন। তাঁদের জবাব দিতে পারছি না!” |
সেই সমস্যা না মিটতেই আবার নতুন সমস্যা। দেহ চিহ্নিতকরণের জন্য মৃতদেহ ময়না-তদন্তের
পরে বাইরে রাখা হবে। সামিয়ানা খাটানো দরকার। কোথা থেকে সামিয়ানা আসবে কেউ ভেবে পাচ্ছেন না। ট্রলিও পাওয়া যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত খোদ স্বাস্থ্যসচিব আর স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা দৌড়লেন ব্যবস্থা করতে। অ্যাম্বুল্যান্সের ভিড়ে তখন মর্গ চত্বরে চলাফেরাই দায়।
সেই সময়েই হাসপাতালে ঢুকে পড়েছে মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পায়ে মর্গের দিকে হেঁটে আসার সময় তাঁর সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ক্ষীণকায় একটি মানুষ। “দিদি, আমার মা-কে ওরা মেরে ফেলল। সেরে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরিয়ে আনতাম। কিন্তু হাসপাতালের লোক আমাকে উপরেই উঠতে দিল না। লিফট বন্ধ করে দিল, মেন গেটে তালা দিয়ে দিল। নিজেরাও অসুস্থ মানুষগুলোকে বার করল না। মা আমার ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মরে গেল!” থমকে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী। আশপাশ থেকে তত ক্ষণে ছুটে আসছেন আরও মানুষ। কেউ অসুস্থ পরিজনকে খুঁজে পাচ্ছেন না, কেউ শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন, কেউ পরিবারের একমাত্র রোজগেরের মৃত্যুর খবর পেয়ে কী করবেন বুঝতে পারছেন না। মুখ্যমন্ত্রীর মুখ থেকে ছিটকে এল কয়েকটি শব্দ, “ওরা তো এই ভাবেই টাকা নেবে বলে রেখে দেয়। আমার অনেক মন্ত্রী, সচিবের আত্মীয়ও মারা গিয়েছেন।”
পাশেই গাছের তলায় বাঁধানো চত্বরে শূন্য দৃষ্টিতে বসেছিলেন সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর সামনেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “চলে যান, দয়া করে চলে যান। মা তো মরে গিয়েছে। আর কী চাই। রবিবার ছুটি করে বাড়ি নিয়ে যেতাম। দম আটকে মা মরে গেল।” অন্য দিকে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে গড়িয়া মহামায়াতলার বাসিন্দা তাপস বসু বললেন, “মায়ের জন্ডিস হয়েছিল দিদি। আজ ছুটি দেওয়ার কথা ছিল। জ্যান্ত মায়ের বদলে লাশ নিয়ে যাব আজ।” তাঁদের সান্ত্বনা দিতে দিতেই মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ কর্তাদের দিকে ফিরে বললেন, “গাড়ির ব্যবস্থা করুন। কম করে ৬০টা গাড়ি চাই। গাড়ি করে মৃতদেহ বাড়িতে পাঠাতে হবে। ঝাড়খণ্ডের এক জন আছে। পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। মৃতদের রঙিন ছবি এখানে, এএমআরআইয়ে টাঙিয়ে দিন।”
ক’টি মৃতদেহ এসেছে, কত জনকে পরিবারের তরফে চিহ্নিত করা গিয়েছে তার লিখিত তালিকা তখনও তৈরি করতে পারেনি প্রশাসন। এক কর্তা মুখ্যমন্ত্রীর কানে কিছু একটা বললেন। তার পরই সাংবাদিকদের উদ্দেশে মমতার ঘোষণা, “দ্রুত ময়না-তদন্ত করে ফেলা হচ্ছে। আমাদের পুরো সরকার নেমে পড়েছে। দমকলের দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত হবে, গ্রেফতার করা হবে দোষীদের। ঘটিবাটি বিক্রি করে লোক এখানে ভর্তি হয়।” তখনও অবশ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত, আহত, নিখোঁজদের কোনও তালিকা তৈরি করতে পারেনি। তালিকা পাঠায়নি আমরিও। অবস্থা আয়ত্তের বাইরে যাচ্ছে দেখে মাইক্রোফোন নিয়ে গাছের তলায় বসে কাজ তদারকি শুরু করেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। ঘোষণা করেন, “এটা ক্রিমিন্যাল অফেন্স। এর শাস্তিস্বরূপ আমরি হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল করে দিলাম।”
দুপুর গড়াতেই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে মর্গ চত্বরে সামিয়ানা খাটিয়ে দেহগুলি রাখা হয়। সেখানেই শনাক্তকরণ শুরু হয়। চত্বরে ঠায় বসে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী। সন্ধ্যায় বিমান বসু পরিস্থিতি দেখতে এলে তাঁর সঙ্গে বেশ কিছু ক্ষণ কথাও বলেন। রাত পৌনে ন’টা পর্যন্ত এসএসকেএমেই ছিলেন মমতা। হাসপাতাল চত্বরে তখনও সাদা চাদর ঢাকা কালো হয়ে যাওয়া দেহগুলি নিয়ে ঢুকছে একের পর এক অ্যাম্বুল্যান্স। প্রিয়জনের খোঁজে উদভ্রান্ত হয়ে দৌড়চ্ছেন অসহায় মানুষ। |