|
|
|
|
হাতে স্যালাইন, বাঁচার আকুল আর্তি |
তড়িৎ পুরকায়েত (স্থানীয় বাসিন্দা) |
দু’চোখ যেন ঠিক্রে বেরিয়ে আসছিল মানুষটা! সেই ভয়ার্ত চোখে ছিল বাঁচার আকুল আর্তি।
তিনতলার ধোঁয়ায় ভরা অন্ধকার ঘরটায় ঢুকে টর্চের আলো ফেলতে প্রথমেই চোখ পড়েছিল ওঁর দিকে। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। হাতে স্যালাইনের ‘চ্যানেল’। ওই অবস্থাতেই মাটিতে ঘষটে ঘষটে দরজার দিকে এগোনোর চেষ্টা করছেন। তাড়াতাড়ি ওঁকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটলাম।
পঞ্চাননতলা বস্তিতে আমার বাড়ির পাশেই এএমআরআই-এর পাঁচিল। রাত তখন আড়াইটে হবে। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে বেরিয়ে দেখি, হাসপাতালের আনাচকানাচ থেকে গলগলিয়ে বের হচ্ছে মিশকালো ধোঁয়া। ঢুকে পড়ছে বস্তিতেও। হাসপাতালের তিন-চারতলার জানলার ও-পাশ থেকে ঠিকরে আসা টর্চের আলোয় আবছা দেখতে পেলাম, জানলার কাচ ভাঙার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। কিন্তু পারছেন না।
বুঝলাম আগুন লেগেছে। পাশের বাড়ি থেকে দুই বন্ধু মনোজ ও রাজুকে ডেকে নিয়ে ছুটলাম হাসপাতালের গেটের দিকে। কিন্তু আটকে গেলাম মেন গেটের সামনে। গেট বন্ধ। ২-৩ জন নিরাপত্তাকর্মী বললেন, ‘‘আপনাদের ভিতরে যেতে দেব না। এটা আমাদের ব্যাপার। আমরাই সামলে নেব।’’
হাসপাতাল চত্বরটা তখন ক্রমশ ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে। রোগীদের আত্মীয়েরা বাইরে এসে কাঁদতে শুরু করেছেন। গেট ধরে ধাক্কাধাক্কি শুরু করলাম আমরা। বস্তি থেকে আরও লোক চলে এসেছে তত ক্ষণে। সামনের গেট বন্ধ থাকায় ঢুকতে না-পেরে কেউ কেউ পিছনের পাঁচিল টপকে ঢোকার চেষ্টা করছে। ধাক্কাধাক্কির জেরে অবশেষে খুলে গেল সামনের গেট। ভিতরে ঢুকে পড়লাম আমরা সকলে।
কিন্তু যাব কোথায়! ঝাঁঝালো গাঢ় ধোঁয়ায় দম একেবারে বন্ধ হয়ে আসছে। কেশে চলেছি ক্রমাগত। চোখ জ্বালা করছে। ফুট তিনেক দূরের জিনিসও ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। তবু সে সব উপেক্ষা করেই ওপরে ওঠার চেষ্টা করলাম আমরা কয়েক জন, নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতের টর্চ কেড়ে নিয়ে।
প্রথম দফার চেষ্টা সফল হল না। ধোঁয়ায় ভরে থাকা অন্ধকার ‘রাস্তা’য় কোন দিকে যাব, বুঝে উঠতে পারলাম না। দম আটকে আসছিল। আউটডোরের একটা সোফার কভার ছিঁড়ে নাক-মুখ ঢেকে দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় উঠতে পারলাম তিনতলায়। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে অসহায় মানুষের গোঙানি।
ঝাঁঝালো গ্যাস-ভর্তি ঘরটায় ঢুকেই ওই মাঝবয়সী ভদ্রলোকের দিকে নজর পড়েছিল। তার পর টর্চের আলো ঘোরাতে দেখলাম, সারি-সারি বেডে শুয়ে দম নেওয়ার জন্য ছটফট করছেন রোগীরা। অক্সিজেনের নল মুখে নিয়েই কেউ-কেউ নামার চেষ্টা করছেন খাট থেকে। এক এক জনকে কোনওমতে উদ্ধার করে বারান্দার তুলনামূলক ‘নিরাপদ’ আশ্রয়ে রেখেই ফিরে যেতে লাগলাম ওই কেবিনে। কিন্তু গোঙানির শব্দ ক্রমশই কমে আসছে। কোণার বেড থেকে এক জনকে উদ্ধার করতে গিয়ে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। টর্চের আলোটা ওঁর মুখে ফেলেই বন্ধ করে দিলাম। দম নেওয়ার প্রবল শেষচেষ্টায় বীভৎস ভাবে খোলা মুখটা। ঠোঁট, নাকের পাশ থেকে চুইয়ে পড়ছে কালো ‘কার্বন’-এর সূক্ষ্ম কণার স্রোত। দেহে প্রাণের স্পন্দন নেই একটুকুও।
হাত কাঁপতে শুরু করল আমার। অক্সিজেনের অভাব যেন আরও বেশি করে টের পেতে লাগলাম। মনে হতে লাগল, এই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাব। শরীরে যতটুকু শক্তি বাকি ছিল তাই দিয়েই কোনও মতে ওই দেহটা আঁকড়ে ধরে বাইরে বেরিয়ে এলাম। |
|
|
|
|
|