প্রাণপণে কাচের জানলাটা ঠেলে খোলার চেষ্টা করছিলেন ভদ্রলোক। একা। নাকে অক্সিজেন মাস্ক।
এএমআরআই হাসপাতালের চার তলা। শুক্রবার ভোর সাড়ে ৩টে। মোটরবাইক দুর্ঘটনায় চোট পেয়ে গত ৩ ডিসেম্বর থেকে এই হাসপাতালের চার তলার কেবিনেই ভর্তি আমার স্বামী শ্রীপদ আচার্য। স্বামীর পাশের কেবিনেই ছিলেন ওই রোগী। আমি তখন মরছি, স্বামীকে কী করে বাঁচাব সেই চিন্তায়। ওই ভদ্রলোককেই বললাম, ‘দাদা একটু ধরুন না। স্বামীকে নীচে নামাব’। উনি এক বার আমাদের দিকে দেখলেন। তার পরে আবার মরিয়ার মতো জানলাটা খোলার চেষ্টা করতে লাগলেন। এ বার চেঁচালাম, ‘নার্স, কেউ আছেন’? সবাই ব্যস্ত নিজের তালে। জানলা খোলার চেষ্টায় ব্যস্ত ওই রোগীকে বললাম, ‘জানলাটা ছাড়ুন। যে ভাবে হোক, নীচে চলুন’।
আমরা আগরতলায় থাকি। রাত ফুরিয়ে সকাল হলেই স্বামীর ‘সিটি স্ক্যান’ হওয়ার কথা। ঘুমোচ্ছিলাম হাসপাতালের দোতলায় রোগীর আত্মীয়েরা যেখানে থাকেন, সেখানে। ঘুমটা ভাঙল এক ঝটকায়। আমাকে ঝাঁকাচ্ছিলেন এক আয়া। বলছিলেন, ‘আগুন লেগেছে। আপনার স্বামীকে নামাতে হবে’। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘিরে ফেলল কালো ধোঁয়া। ঝাঁঝালো গন্ধ। কাশি শুরু হল। গলা শুকিয়ে কাঠ। কিছুটা ধোঁয়া ঢুকে, কিছুটা দুশ্চিন্তায়।
হাসপাতালে তখন আমি একা। অন্য আত্মীয়েরা সল্টলেকের ত্রিপুরা ভবনে। চার তলা থেকে স্বামীকে নামাব কী করে?
সিঁড়ির দিকে দৌড়লাম। তিন তলা অন্ধকার। গত কয়েক দিন এএমআরআই-তে কাটিয়ে কোন তলায়, কী রয়েছে মোটামুটি চিনে গিয়েছি। সেই ভরসাতেই এগিয়ে চললাম। ততক্ষণে বিভিন্ন ঘরের রোগীরা, নার্সেরা ছোটাছুটি করছেন। কানে এল, এক নার্স কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, ‘আমার ছোট্ট ছেলেটার কী হবে! আমি ছাড়া ওর যে আর কেউ নেই!’ আমার মাথায়ও তখন একটাই চিন্তাস্বামীর কী হবে! হোঁচট খেয়ে প্রায় হাতড়ে পৌঁছলাম চার তলায়। স্বামীর কেবিনের দরজা ঠেলে দেখি, এক নার্স ওঁকে বিছানা থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করছেন। নার্সকে বললাম, ‘ওঁকে ছাড়ুন, পারলে অন্যদের দেখুন’। নার্স দোতলার দিকে ছুটে যেতে যেতে বলে গেলেন, ‘সাবধানে দেখে নামবেন।’
আমার স্বামী তখনও তন্দ্রাচ্ছন্ন। এক টানে ওঁর হাত থেকে স্যালাইনের সুচ খুলে বললাম, ‘তাড়াতাড়ি ওঠো। একতলায় নামতে হবে।’
মানুষটা তখন টলছে। ওজনও আমার থেকে বেশি। ওঁকে নামাব কী করে ভাবছি আর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছি, ‘কেউ একটু ধরবেন। তা হলে লোকটাকে নীচে নামাতে পারতাম’। সাহায্য করার মতো কেউ নেই বুঝে ঠিক করে ফেলি, টেনে-হিঁচড়ে যে ভাবে হোক, স্বামীকে আমি-ই নীচে নামাব। অন্ধকারের মধ্যে স্বামীকে জড়িয়ে রেখে সিঁড়ির এক-একটা ধাপ নামছি, আর নাকে-মুখে ধোঁয়া ঢুকে হাঁফ ধরে যাচ্ছে। ঠাকুরকে বলছি, ‘শক্তি দাও’। কত ক্ষণে দোতলায় নেমেছি, জানি না। মনে হচ্ছিল এক যুগ।
দোতলার আলোও তখন নিভে গিয়েছে। নাক জ্বলছে ঝাঁঝালো গন্ধে। এরই মধ্যে দেখি, মেঝেতে পাতা রয়েছে একটা বিছানা। স্বামীকে বললাম, ‘চুপ করে শুয়ে পড়ো। একটু দম নাও’।
দুদ্দাড় করে কারা যেন ঢুকল হাসপাতালে। পরে জেনেছি, ওরা পাড়ার ছেলে। রোগীদের বাঁচাতে এসেছিল। ভোর হল। পুলিশ এল। দমকল এল। অনেক পরে কয়েকজন এসে বলল, সল্টলেকের এএমআরআই-তে আমার স্বামীকে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে এসেছি স্বামীর সঙ্গে।
জানলা খোলার চেষ্টা করছিলেন যিনি, জানি না শেষ পর্যন্ত তিনি নীচে নামতে পেরেছেন কি না। |