হাসপাতাল চত্বরে থাকা সহকর্মী থেকে শুরু করে পুলিশ, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কর্মী সকলেই বারবার বারণ করেছিলেন ভিতরে যেতে। কিন্তু ‘খবর’টা সত্যি না গুজব, সেটা যাচাই করার জন্য ঝুঁকিটা যে নিতেই হবে। দমবন্ধ হয়ে মারা যাওয়া অনেকগুলি সদ্যোজাতের দেহ নাকি পড়ে রয়েছে পাঁচতলায়। নিশ্চয়ই এটা গুজব! বারবার এই বলেই শক্ত করছিলাম মনটাকে।
সঙ্গে থাকা অন্য দুই সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরও মনের অবস্থা আমাদেরই মতো। শুক্রবার দুপুর তখন সাড়ে বারোটা হবে। ভিতরে ঢুকলাম অজস্র কাচের টুকরো মাড়িয়ে। ডান দিকে ‘অনুসন্ধান’ ডেস্ক থেকে শুরু করে আর যা কিছু সবই ঢেকে রয়েছে কালো ধোঁয়ায়। কয়েক পা এগোতেই টের পেলাম, ধোঁয়া ভেদ করে ঝাঁঝালো একটা গন্ধ ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে। একটা অন্ধকার ঘনিয়ে এল ঝুপ করে। শিউরে উঠলাম! “এ বার কোন দিকে?” প্রশ্ন এক সঙ্গীর। তড়িঘড়ি মোবাইলের টর্চ জ্বাললেন আর এক জন।
ধোঁয়া চিরে কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত ঘুরল আলোটা। ঠাওর করতে পারলাম না কোন দিকে যাব। হঠাৎই বাঁ দিকের সিঁড়িটা চোখে পড়ল। কোনও মতে উঠতে লাগলাম রেলিং আঁকড়ে। জুতোটা পিছলে যাচ্ছে কেন? মোবাইলের আলোটা ফেলতেই দেখা গেল, ধুলো-ধোঁয়া মিশে কুচকুচে কালো এক আস্তরণে ঢেকে গিয়েছে সিঁড়িগুলো। ধোঁয়া আর তাপ, দু’টোই যে আরও বাড়বে, সেটা আন্দাজ করেই আরও শক্ত করে নিলাম নাকে বাঁধা মাস্কের গিঁটগুলো।
একতলায় পা দিয়েই থমকে গেলাম। যে দিকে তাকাই, শুধু গরম ধোঁয়া। “উপরের তলাগুলোর কী অবস্থা তা হলে?” এক সঙ্গী প্রশ্নটা করতেই বিভ্রান্তের মতো একে অন্যের মুখের দিকে তাকালাম। ঠিক করলাম, আর ভাবব না। পাঁচতলায় পৌঁছতেই হবে। যে করেই হোক।
আরও দু-তিন পা উঠতেই একটা শব্দ কানে এল। তড়িঘড়ি দেখতে গিয়ে পা পিছলে পড়লেন এক সঙ্গী। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে দেওয়ালে হাত ঠেকে গেল। তখনও দেওয়ালটা তেতে রয়েছে! বিস্ময় কাটতে না কাটতেই দু’টো হলদে আলোর রেখা চোখে পড়ল। কারা যেন কথা বলছেন। যে সঙ্গীর হাতে মোবাইল, তিনি ফিসফিস করে বললেন, “ওঁরা বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর লোক।” বুঝলাম, আমাদের কথাবার্তা কানে এলে ‘সঙ্গত’ কারণেই ওঁরা নেমে যেতে বলবেন। এক মুহূর্তও দেরি না করে আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলাম সন্তর্পণে। |
এ বার টের পাচ্ছি গরমটা একটু একটু করে বাড়ছে। দুই, তিন, চারতলা বেরিয়ে অবশেষে পাঁচতলার সিঁড়িতে পা দিলাম। তত ক্ষণে একটা বিশ্বাস জন্মেছে, পাঁচতলায় কেউ নেই। এক জন আর এক জনের হাত ধরে বলছি, “খবরটা গুজবই হবে, বলো?” অন্য জন তখন সেই হাতটা আরও জোরে চেপে ধরছে।
পাঁচতলায় পৌঁছতেই দম বন্ধ হয়ে এল! ঝাঁঝালো গন্ধের ধোঁয়া এতটাই তীব্র, মাস্কের উপরেও হাত চাপা দিতে হল। ধোঁয়ার জ্বালায় চোখ বেয়ে গড়ানো জ্বলে চশমাটাও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আমরা খুঁজে চলেছি ‘এনআইটিইউ’ অর্থাৎ ‘নিও নেটাল ইনটেনসিভ ইউনিট’। সেখানেই রাখা হয় সদ্যোজাতদের। মনে মনে তখনও প্রার্থনা চলছে গুজবটা যেন সত্যি না হয়।
আচমকাই চোখ গেল ‘আইসিসিইউ’-তে। খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই দেখলাম, কুচকুচে কালো মেঝের উপর অজস্র পায়ের ছাপ। বুঝলাম, সকাল থেকে অনেকেই হয়তো এসেছেন এখানে। কেউ উদ্ধারকাজে, কেউ বা আমাদেরই মতো, পেশার তাগিদে।
২৪২১ থেকে ২৪২৯ পর্যন্ত ‘বেড’ রয়েছে ভাঙাচোরা ওই ইউনিটে। কিন্তু একটাও ‘নিয়ম মেনে’ সাজানো নেই। অবিন্যস্ত ডেস্কের সাদা বোর্ডে আট জন রোগীর নাম। প্রথম নামটার পাশে লেখা তিনটি ইংরেজি অক্ষর: ডিআইএস (‘ডিস’) অর্থাৎ ‘ডিসচার্জড’। কালো মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে কম্পিউটার। ল্যান্ডফোনের রিসিভার তারসমেত ঝুলে রয়েছে। ফ্রিজের মাথায় চা-কফির ফ্লাস্ক। বিছানার দোমড়ানো চাদর মেঝেতে লুটোচ্ছে। লেপ-বালিশ অগোছালো। বুঝতে পারছিলাম, যে ভাবে পারা যায়, মুমূর্ষু রোগীদের বার করে আনার চেষ্টা চালিয়েছে উদ্ধারকারী দল। তাড়াহুড়োয় ‘ইমার্জেন্সি অ্যাসেম্বলি পয়েন্ট’ (ওই তলার আপৎকালীন বারান্দা) দিয়ে বার করার সময়ে আঘাত পাননি তো ওই রোগীদের কেউ? ভাবনাটা হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। প্রায় অন্ধকার ইউনিটে দাঁড়িয়ে দেখছি, স্যালাইনের স্ট্যান্ড মাটিতে গড়াচ্ছে। ইতস্তত পড়ে টুথপেস্টের টিউব, রক্তচাপ মাপার যন্ত্র, কয়েকটা স্টেথোস্কোপ। বিছানার পাশে ওষুধের তাকগুলোও এলোমেলো। তাতে এখনও রাখা কয়েকটা জলের বোতল। অথচ আশ্চর্য, কোথাও আগুনে পোড়ার চিহ্ন দেখলাম না।
এই তলাতেই অন্ধকারের মধ্যে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছিলেন কয়েক জন। তাঁদেরই এক জন বললেন, “শুনছিলাম এই তলাতেই হাসপাতালের কন্ট্রোল রুমটা ছিল। কিন্তু চোখে তো পড়ল না।” আর কথা বলতে পারছিলাম না। শ্বাসকষ্ট বাড়ছিল। ঢোঁক গিলতেও পারছি না, মুখে একটা তেতো স্বাদ। নীচে নামতে লাগলাম। তার ফাঁকেই দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম বিভিন্ন তলার ইউনিটে। প্রায় একই ছবি সর্বত্র। গরম ধোঁয়া। কুচকুচে কালো আস্তরণ দেওয়াল-মেঝে-বিছানায়। ফাইলপত্র মাটিতে লুটোচ্ছে। কোথাও পড়ে একটা স্ট্রেচার। কোথাও কালি মেখে পড়ে রয়েছে প্রেসক্রিপশন।
এক সময়ে বেরিয়ে এলাম। ‘নিও নেটাল ইনটেনসিভ ইউনিট’ আমরা খুঁজে পাইনি কোত্থাও। বেরোনোর পরে এক সহকর্মী জানালেন, ওই ইউনিটটা আসলে হাসপাতালের অন্য বিল্ডিংয়ে।
এতক্ষণে সত্যি সত্যিই বিশ্বাস হল, গুজবটা সত্যি নয়। |