চাদরে মোড়ানো একটা শরীর প্রায় পায়ের উপরে এসে পড়ল। এএমআরআই হাসপাতালের পুরনো বিল্ডিংয়ের এক তলায় লিফটের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কয়েক মুহূর্তের জন্য শরীর অবশ হয়ে গেল। ততক্ষণে আশপাশের ভিড় আছড়ে পড়েছে দেহের উপরে। মুখের চাদর সরিয়ে সকলেই দেখে নিতে চাইছেন, দেহটি তাঁদেরই পরিবারের কারও কি না।
বছর পঁচিশের ছিপছিপে যুবকটি তার আগে নাগাড়ে বলে চলেছিলেন, “আমার বাবাকে খুঁজে পাচ্ছি না। নিশ্চয় বেরিয়ে যেতে পেরেছে। আশেপাশেই আছে হয়তো।”
কয়েক মুহূর্ত পরে কিছু একটা সন্দেহ হওয়ায় অন্যদের মতোই ঢাকাটা এক বার সরালেন তিনি। তার পরেই একটা তীক্ষ্ন চিৎকার। দুর্গাপুরের শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় শনাক্ত করলেন বাবা তুষারকান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বাবার মুখটা নিজের দু’হাতের মধ্যে নিয়ে তিনি গোঙাচ্ছিলেন। “তুমি তো তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে চেয়েছিলে!” লিফটের
পাশে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া ছেলের কান্না আটকানোর মতো কেউ তখন নেই। প্রত্যেকেই যে যার নিজের লোককে খুঁজে বের করতে মরিয়া। অল্প ক্ষণ পরেই হাসপাতালের রিসেপশন কাউন্টারের দিকে ছুটলেন তিনি। “প্লিজ কেউ একটু দেখুন। হয়তো এখনও বেঁচে আছে। যা হোক কিছু ব্যবস্থা করুন।” কিন্তু তাঁর কথা শোনার অবস্থা-ও তখন কারও নেই।
ভোর থেকে হাসপাতালে জড়ো হওয়া ওই অসহায় মানুষগুলোর কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য হাসপাতালের তরফেও কারও দেখা মেলেনি। এক কর্মী একবার অন্যত্র স্থানান্তরিত করা রোগীদের তালিকা টাঙিয়ে দিয়ে গেলেন রিসেপশন কাউন্টারে। কিন্তু সেই তালিকার এমনই অবস্থা যে, নামগুলো ভাল ভাবে পড়তেই পারছিলেন না কেউ। এক জন চেঁচিয়ে উঠলেন, “কিছু একটা জানান। আমাদের পেশেন্ট যে মারা গিয়েছে, সেটুকু অন্তত জানিয়ে দিন।” এই কথায় সাড়া দেওয়ার মতো আশপাশেই কেউ নেই।
ইতিমধ্যেই নতুন বিল্ডিং থেকে পুরনো বাড়ির লিফটের পাশে জড়ো করা হয়েছে আরও কয়েকটি মৃতদেহ। হাসপাতালের কর্মীরা যে ভাবে হেলায় দেহগুলিকে কার্যত ছুড়ে ফেলছিলেন, সেটা সহ্য করা বেশ কঠিন। চিৎকার করে উঠলেন এক যুবক, “এঁরা কি কুকুর-বেড়াল নাকি? এ ভাবে কেন ছুড়ছেন? কেউ তো এখনও বেঁচে থাকতে পারেন!”
আর এক যুবক তখন থরথর করে কাঁপছেন। তাঁর স্ত্রী তিন দিন ধরে ভর্তি ছিলেন ওখানকারই মেডিসিন ওয়ার্ডে। তাঁর দেহটিও এনে রাখা হয়েছে এক তলার একটা ঘরের মেঝেয়, আরও কয়েকটা দেহের পাশে। স্ত্রীর কপালে, ঠোঁটে, হাত বোলাচ্ছিলেন তিনি। বারবার চেপে ধরছিলেন হাতটা। কত আর বয়স হবে মেয়েটির? বড় জোর বছর ত্রিশ। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওই যুবক বললেন, “একটু দেখুন না, মনে হচ্ছে এখনও বেঁচে আছে। আমার তো হাত কাঁপছে। তাই পাল্স দেখতে পারছি না। একটু হেল্প করুন না প্লিজ।” কী বলব ওঁকে? মেয়েটির হাতের কব্জি কয়েক মুহূর্ত চেপে থেকে বললাম, “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। একটু ধৈর্য ধরুন, ডাক্তার আসবেন এখনই।” |
“আসবে না, কোনও ডাক্তার এখন আসবে না।” বলতে বলতে কান্নায় গলাটা বিকৃত হয়ে গেল তাঁর। ছুটতে ছুটতে রিসেপশনের সামনে এলাম। গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে এক ব্যক্তিকে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতে দেখলাম। ওঁকে অনুরোধ করলাম, “একবার ওই ঘরে চলুন। হয়তো কোনও লাভ নেই, তবু এক বার দেখুন। বাড়ির লোকজন তাতে অন্তত একটু সান্ত্বনা পাবেন।” তিনি আমাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন, “এখন খুব ব্যস্ত। একটু পরে আসছি।” ওই মুহূর্তে ওই কাজের চেয়ে বেশি ব্যস্ততা আর কীসে থাকতে পারে, তা বোধগম্য হয়নি। এবং সেই ‘পরে’ আসার সময়ও তিনি আর বের করে উঠতে পারেননি। ঘণ্টা খানেক পরে ওই তরুণীর মৃতদেহ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে এসএসকেএম হাসপাতালে। ময়না-তদন্তের জন্য।
এ দিন ভোর থেকেই একটার পর একটা দৃশ্য সমস্ত চেতনাকেই যেন বিকল করে দিচ্ছিল। দমকলকর্মী আর স্থানীয় উদ্ধারকারীদের সাহায্য নিয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করতেই পা যেন মাটির সঙ্গে আটকে গেল। ভাল করে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। চোখ জ্বালা করছে। কোনওমতে একটু সইয়ে সামনে তাকাতেই চোখে পড়েছিল, চাদরে মুড়ে পর পর নীচে নামানো হচ্ছে কয়েকটা নিথর দেহ। কালচে হয়ে গিয়েছে মুখগুলো। কারও নাকে তখনও অক্সিজেনের মাস্ক। কারও হয়তো স্যালাইন চলছিল। হাত থেকে নল ঝুলছে। এক জনের চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। হয়তো শেষ
মুহূর্ত পর্যন্ত বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন। ব্যর্থ হচ্ছেন, সেটা ভাল করে
বোঝার আগেই হয়তো শেষ নিঃশ্বাসটা পড়ে গিয়েছে।
চার পাশে দমকলকর্মী আর স্থানীয় উদ্ধারকারীদের ভিড়। উপরে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে ওঁরাই বারণ করলেন। চার পাশ তখনও ধোঁয়ায় অনেকটাই ঢাকা। কোনও মতে নীচে নামলাম। অজস্র উদ্বিগ্ন মুখ। সকলেই খুঁজছেন তাঁদের নিজের লোককে। কানে ফোন নিয়ে অবিরাম চেষ্টা করে চলেছেন হদিস পাওয়ার। পুরনো বাড়ির এক তলায় ফিরে বাঁ দিকে লিফটের দিকে দৌড়ে যেতেই হোঁচট খেলাম। একটা ঘরের পাশে আধো অন্ধকারে একটা চাদর মোড়া দেহ শুইয়ে রাখা হয়েছে। অনেকেই ঠোক্কর খাচ্ছেন সেই দেহে। সেটি সরিয়ে জায়গামতো পৌঁছে দেওয়ার কোনও উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষের। মৃত্যুর পরেও কোনও মানুষের অস্তিত্বকে কতটা তুচ্ছ করা যায়, এই উদাসীনতা হয়তো তারই প্রমাণ। তত ক্ষণে হাসপাতালের কয়েক জন কর্মী আর একটি দেহকে কার্যত ছুড়ে দিলেন সেখানে। কারও এক মুহূর্ত সময় নেই। পরের দেহটা বয়ে আনতে হবে যে!
প্রথমে হাসপাতালের রিসেপশনে, তার পরে টলতে টলতে হাসপাতালের সামনে গাছের তলায় এসে বসে পড়েছিলেন নীলাব্জ হালদার। স্ত্রী চন্দ্রাণীর সঙ্গে গাড়িতে মুকুটমণিপুর বেড়াতে গিয়েছিলেন। বুধবার রাতে ফেরার পথে দুর্ঘটনা। দু’জনকেই ভর্তি করা হয়েছিল এএমআরআই-তে। আইটিইউ-এ ছিলেন চন্দ্রাণী। প্রথমে তাঁর কোনও খোঁজ মেলেনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফেও ন্যূনতম সহায়তা মেলেনি। গাছের নীচে বসে থাকা নীলাব্জকে ভিতরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন এক চিকিৎসক। কিন্তু তাঁর এক গোঁ, “আমার স্ত্রীর খোঁজ না পাওয়া গেলে কোথাও যাব না।” বন্ধুবান্ধবেরাও সামলাতে পারছিলেন না তাঁকে। নীলাব্জ বলছিলেন, “চন্দ্রাণী একদম ধোঁয়া সহ্য করতে পারে না। ও কী ভাবে এই দম বন্ধ করা অবস্থায় থাকবে?” নিথর চন্দ্রাণীর খোঁজ মিলল ঘণ্টা কয়েক পরে। এসএসকেএমে ময়না-তদন্তে পাঠানো দেহের ভিড়ে।
ওই মৃত্যুস্তূপের মধ্যে কয়েকটা ঘণ্টা কী দ্রুত কেটে গেল বোঝাই যায়নি। এক তলায় লিফটের ধারে কয়েকটা মৃতদেহ, কোণের ঘরে দেহ, পুরনো বাড়ির দোতলা-তিনতলার ঘরে জমিয়ে রাখা দেহ। মৃতদেহের স্তূপে দাঁড়িয়ে আছি। ব্যাগ থেকে নোটবই বা পেন বার করতেও যেন সঙ্কোচ হচ্ছে। হঠাৎই চমকে উঠলাম। হাসপাতালের এক কর্মীর পা জড়িয়ে ধরেছেন এক প্রৌঢ়। বলছেন, “জমি বিক্রি করে দু’লাখ টাকা দিয়েছি। আরও দেব। সব দিয়ে দেব, বিশ্বাস করুন। কিন্তু যে করে হোক স্ত্রীকে বাঁচিয়ে দিন।” |