বিষ-ধোঁয়ায় দম আটকেই লড়াইয়ে ইতি
শক্ত শরীরগুলো কোনও মতে ঠেলে বদ্ধ ‘মৃত্যুকূপ’ থেকে বেরোনোর আকুতিতে ছটফট করছে কয়েকটা অসহায় মুখ। ভিতরে ঢুকে তাঁদের বাঁচাতে এগিয়ে আসা স্থানীয় যুবকদের ভিড়টাও একই রকম অসহায়। এ’দুয়ের মাঝখানে ‘প্রাচীর’ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষীরা।
বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আগুন ও ধোঁয়া দেখে এগিয়ে এসেছিলেন ঢাকুরিয়ার আমরি (এএমআরআই) হাসপাতালের লাগোয়া পঞ্চাননতলা বস্তির বাসিন্দারা। কিন্তু নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁদের ঢুকতে দেননি বলে ওই যুবকদের অভিযোগ। দমবন্ধ-করা ধোঁয়ার গন্ধে সংযুক্ত ভবনের (অ্যানেক্স বিল্ডিং) ঘুম ভাঙার পরে দু’-আড়াই ঘণ্টা এ ভাবেই পেরিয়ে গেল। তত ক্ষণ ‘উদ্ধারে’র আশায় মোবাইলে পাগলের মতো প্রিয়জনকে ফোন করে গিয়েছেন হাসপাতালের ভিতরে ‘বন্দি’ রোগীর দল। এর মধ্যেই বাধা না-মেনে বাঁশের ভারা বেয়ে উঠে কাচ ভেঙে উদ্ধার-কাজ শুরু করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তখন অবশ্য অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এলাকার লোকেই থানা ও দমকলে ফোন করেন। অভিযোগ, সবাই মিলে হাত লাগিয়ে উদ্ধার-কাজ শুরু হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তখনও ঘটনাস্থলে দেখা যায়নি।
কয়েক ঘণ্টার এই দেরিতেই ক্ষতি হয়ে গেল অনেক। বিপন্ন মানুষের আর্তস্বরের মাঝে বহু কষ্টে ভিতরে ঢুকে তাঁদের উদ্ধার করতে দমকল কর্মীদেরও কালঘাম ছোটে। দমকলের দাবি, আগুন লেগেছিল হাসপাতালের ভূগর্ভস্থ তল বা বেসমেন্টের উত্তর-পশ্চিম কোণে। উপরের তলাগুলিতে সেই আগুন ছড়িয়ে পড়েনি। কিন্তু স্রেফ ধোঁয়ার গ্রাসেই দম আটকে অন্তত ৯০ জন রোগী অসহায় ভাবে মারা গিয়েছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও অনেকে।
পুরনো কলকাতার কোনও ঘুপচি গলি নয়। নয় এ শহরের আদ্যিকালের কোনও ভাঙাচোরা বাড়ি। দক্ষিণ কলকাতায় মাত্র বছর সাতেক আগে গড়ে ওঠা ঝকঝকে বহুতলটিতে যে আগুনের গ্রাসে এমন ‘ট্র্যাজেডি’ ঘটতে পারে, তা স্বপ্নেও ভাবেননি বেসরকারি হাসপাতালটিতে ভর্তি হওয়া ‘হতভাগ্য’ রোগী বা তাঁদের পরিজনেরা।
রোগীর আত্মীয়দের বক্তব্য, অবশেষে ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ পঞ্চাননতলার বাসিন্দারা ভিতরে ঢোকেন। দমকলের ইঞ্জিন দ্রুত ঘটনাস্থলে চলে এলেও এ ধরনের উদ্ধার-কাজে জরুরি শ্বাসযন্ত্রের অভাবে ভুগতে হয়। শ্বাসযন্ত্র নাকে এঁটে বা জানলায় যন্ত্রচালিত মই লাগিয়ে ভিতরে ঢুকতে সকাল সাড়ে ছ’টা বেজে যায়। এর পরেই মূল উদ্ধার কাজ শুরু হয়। তত ক্ষণে বাতাসের অভাবে ছটফট করতে করতে অসহায় রোগীদের একটা বড় অংশ মৃতপ্রায়। পুলিশের বক্তব্য, ‘উদ্ধারে’র পরে অনেককেই আর চিকিৎসার জন্য অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার দরকার পড়েনি। অগ্নিকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালের তিন তলায় ডায়ালিসিস ইউনিটে ঢুকে দেখা গেল, অস্ত্রোপচার-কক্ষের বাইরের করিডরে ডাঁই করা দেহের ভিড়ে পা রাখাই দায়। নিথর শরীরগুলোর গায়ে পোড়া দাগ নেই। কারও কারও মুখে বা নল-গোঁজা নাকের পাশে কার্বনের কালো-কালো ছোপ।
বিফলে গেল প্রাণের খোঁজ। স্বজনের মৃতদেহের পাশে বসে কান্নায় ভেঙে পড়লেন যুবক।
শুক্রবার ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালে। ছবি: সুমন বল্লভ
রামলাল বাজারের মুনমুন চক্রবর্তীর বোন অর্পিতা হা-হুতাশ করছিলেন, “আজ সকালে দিদিই ফোন করে আমাদের হাসপাতালের আগুন লাগার খবর দেয়। বলে তাড়াতাড়ি চলে এস। এসেওছিলাম। কিন্তু কেউই ভিতরে ঢুকতে পারলাম না। পরে যখন ওকে নামানো হল, সব শেষ।” চার তলায় চিকিৎসাধীন অজয় ঘোষালের কাছেই ছিলেন তাঁর বোন ইন্দিরাদেবী। দুপুরে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে ওই প্রৌঢ়া বলছিলেন, “পাড়ার ছেলেরা এসে জানলা ভেঙে আমাদের নীচে নামাতে এলে দাদা বলছিলেন, আগে তুমি নামো। আমার কিচ্ছু হবে না। কেন যে আমি ওর কথা শুনতে গেলাম।” সকাল সওয়া পাঁচটার মধ্যে অজয়বাবুকে নামানো গেলেও শেষ রক্ষা হয়নি। বেলা ১০টা নাগাদ ওই হাসপাতালের আইটিইউ-তে তিনি মারা যান।
অ্যানেক্স বিল্ডিং থেকে রোগীদের নামানো শেষ হলেও হাসপাতালের কর্তাদের বিশেষ দেখা যায়নি। ইতিমধ্যে প্রিয়জনের খোঁজে রোগীর পরিজনেরা হন্যে হয়ে উঠেছেন। আইটিইউ-তে কয়েক জন চিকিৎসক তাঁদের কাজ করে গেলেও আমরি-র মূল ভবনের বিভিন্ন তলার কাউন্টারগুলি কার্যত অঘোষিত ‘ছুটি’র চেহারা নেয়। বেলা ১০টা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত হওয়ার সময়েও এই ‘নৈরাজ্য’ পুরোপুরি বহাল। ফলে, মুখ্যমন্ত্রীকে দেখেই অনুযোগ জানাতে উদভ্রান্তের মতো ছুটেছেন রোগীর পরিজনেরা। মাইকে ঘোষণা করে, মমতা তাঁদের ‘শান্ত’ করার চেষ্টা করেছেন। ভিড়-ঠেলাঠেলির জেরে পুলিশ এক সময়ে লাঠি চালিয়েছে বলে অভিযোগ। ক্ষুব্ধ জনতাও হাসপাতালে ভাঙচুর করেছে।
উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বা ‘হাই-রিস্ক’ বহুতলগুলির অগ্নি-সুরক্ষায় কেন্দ্রীয় আইন মোতাবেক কয়েকটি সুপারিশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার কথা শহরের যে-কোনও উঁচু ভবনের। বহু বছর আগে নির্মিত পুরনো বাড়িগুলিতে এ সব আইন কার্যকর করার কিছু বাস্তব অসুবিধার কথা দমকল বা পুরকর্তারাও স্বীকার করে থাকেন। কিন্তু ঢাকুরিয়ার হাসপাতালটির সংযুক্ত-ভবনটি ২০০৪ সালের পরে নির্মিত। বড়বাজার বা পোস্তার কোনও অফিস-বাড়িতে অগ্নি-কাণ্ডের পরে আগুন নেভানোর যে-সব সরঞ্জামের অভাব নিয়ে দমকলকর্তারা বার বার অভিযোগ করেন, এএমআরআই হাসপাতালে খাতায়-কলমে তার অভাব ছিল না। কিন্তু এ দিন ভোরে অগ্নি-কাণ্ডের পরে সে-সব কোনও কিছুই কার্যত ছিটেফোঁটা কাজে আসেনি। রোগীর পরিজনেরা বলেন, আগুন লাগার পরে বিপদ-ঘণ্টি অবধি বাজেনি। অনেক পরে বিষাক্ত গন্ধে রোগীদের ঘুম ভাঙতে ভাঙতেই ঢের দেরি হয়ে গিয়েছে। জল ছেটানোর যন্ত্র ‘স্প্রিংকলার’ও কাজ করেনি।
কেন কাজ করল না হাসপাতালের অগ্নি-সুরক্ষা ব্যবস্থা? হাসপাতালের মুখপাত্র সত্যব্রত উপাধ্যায়ের দাবি, “বাড়িটির দমকলের ছাড়পত্র রয়েছে। গাড়িও তো ব্রেক-ফেল করে! যন্ত্রের কখন কী হবে, কে বলতে পারে।” দমকল কর্তাদের কিন্তু সরাসরি অভিযোগ, ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী, নিয়মিত তালিমপ্রাপ্ত আগুন নেভাতে পটু যে পেশাদারদের হাসপাতালে থাকার কথা, বাস্তবে তাদের কাউকেই দেখা যায়নি। হাসপাতালে আগুন নেভাতে কর্মীদের তালিম দেওয়ার রেওয়াজ নিয়েও দমকল-কর্তারা প্রশ্ন তুলেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিজ্ঞতা বলছে, শয্যাশায়ী চলৎশক্তিহীন কোনও কোনও রোগী যখন ভিতরে অসহায়ের মতো ছটফট করছেন, তখন তাঁদের উদ্ধার না করে হাসপাতালের কয়েক জন বালতির জল ঢেলে বেসমেন্টের আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলেন!
দমকলের অধিকর্তা গোপাল ভট্টাচার্য জানান, প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে শটসার্কিট থেকেই বেসমেন্টের সেন্ট্রাল স্টোরে আগুন লাগে। সেখানে গুদামঘরের মতো জড়ো-করা বিভিন্ন বৈদ্যুতিক কেব্ল ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ রাখা ছিল। ওই সব দাহ্য পদার্থ জ্বলেই ধোঁয়া ছড়ায়। এসি ডাক্টের (বাতানুকূল যন্ত্রের পাইপ) মধ্যে দিয়ে ধোঁয়া দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে উপরের তলাগুলিতে। দমকলের আর এক কর্তার বক্তব্য, “এসি ডাক্টের ভিতরে গরম ধোঁয়া আটকানোর যন্ত্র ডাম্পার থাকে। কিন্তু সেটাও কাজ করেনি। করলে গরম ধোঁয়া হাসপাতালের ভিতরে ছড়াতে পারত না। এত জন রোগীও অসহায় ভাবে মারা যেতেন না।” এ দিন দুপুর সওয়া দু’টো নাগাদ আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে বলে দমকল জানিয়েছে। বেসমেন্টে ওষুধপত্র রাখার গুদাম বানিয়েও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিয়ম ভেঙেছেন বলে কলকাতা পুরসভার তরফে জানানো হয়েছে। পুরকর্তারা জানান, বেসমেন্টে গাড়ি রাখার অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সেখানে গুদামঘর গড়ে তোলা হয়।
মৃত ৯০
শনাক্ত ৮৯
লেক থানায় দমকলের এফআইআর
হাসপাতালের ৭ কর্তা গ্রেফতার
(এস কে তোদি, আর এস গোয়েনকা, মণীশ গোয়েনকা,
প্রশান্ত গোয়েনকা, রবি তোদি, ডি এন অগ্রবাল, রাধেশ্যাম অগ্রবাল)
ঢাকুরিয়া এএমআরআই-এর লাইসেন্স বাতিল
তদন্ত করবে গোয়েন্দা পুলিশের বিশেষ দল
মৃতদের পরিবারকে অর্থ সাহায্য, অভাবীদের চাকরি
প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, স্টিফেন কোর্ট থেকে নন্দরাম মার্কেট-শহরের কোনও বহুতলে আগুন লাগার পরে বিপর্যয় মোকাবিলার যে ‘দৈন্যদশা’ দেখতে কলকাতা অভ্যস্ত এ দিন ভোর চারটে-সওয়া চারটে থেকে পরের দু’-তিন ঘণ্টা আমরি-র দৃশ্যও তার থেকে আলাদা নয়। দমকলের কোনও কোনও কর্তাও ঠারেঠোরে মানছেন, ২০০৮ সালের নন্দরাম-কাণ্ড বা ২০১০ সালে স্টিফেন কোর্টের ট্র্যাজেডি-র পরে কয়েক কোটি টাকা দিয়ে আগুন নেভানোর উন্নত সরঞ্জাম কেনার কথা বলা হলেও বাস্তবে দমকলের ভাঁড়ারে জরুরি সরঞ্জামের অভাব এখনও ঘোচেনি। দমকল সূত্রের খবর, মাত্র ২০টি শ্বাস-যন্ত্র বা ব্রিদিং অ্যাপারেটাস নিয়ে আগুনের সঙ্গে যুঝতে হয়। স্টিফেন-কোর্ট-কাণ্ডের পরে গড়ে তোলা কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর হাতেও চারটি ব্রিদিং অ্যাপারেটাস। আধ ঘণ্টা অন্তর তাতে হাওয়া ভরে ভিতরে বিপন্নদের উদ্ধারে নামা হয়। পুলিশ সূত্রের খবর, কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা দমকলমন্ত্রী জাভেদ খানের কাছে পুলিশের শ্বাসযন্ত্র চাইলেও দমকল তা দিতে পারেনি।
এত বড় বিপদে আমরি হাসপাতালের ‘অপ্রস্তুত’ দশা মালুম হয়েছে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে। আগুন নেভানোর সরঞ্জাম বা বাতানুকূল যন্ত্র কাজ না-করার পাশাপাশি দমকল এ দিন হাসপাতাল-চত্বরে ঢোকার অপরিসর রাস্তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। দমকল সূত্রের খবর, সরু জায়গা দিয়ে অ্যানেক্স-বিল্ডিংয়ের সামনে যেতে দমকলের ৩০ ফুট উঁচু একটি যন্ত্রচালিত মইয়ের গাড়ি ধাক্কা লেগে অকেজো হয়ে যায়। অপরিসর ওই প্রবেশ-পথটিকে কী ভাবে দমকলের অনুমোদন পেল তা নিয়েও দমকলের একাংশই প্রশ্ন তুলেছেন। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধদমন) দময়ন্তী সেন বলেন, “আগুন নেভানোর বিষয়টি তদন্ত করতে আরও ১০-১২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।” রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য অধিকর্তা (শিক্ষা) সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ও আমরি-এর পরিচালক-মণ্ডলীর সদস্য। অগ্নি-কাণ্ডের তদন্তে সবার ভূমিকাই খতিয়ে দেখা হবে বলে যুগ্ম কমিশনার জানিয়েছেন।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.