সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা হয়নি। শুক্রবারই কলকাতায় আমরি হাসপাতালে বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের বলি হয়েছেন একের পর এক রোগী। অথচ, বর্ধমান জেলা ও শহরের অধিকাংশ নার্সিংহোমে কোনও অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থাই নেই। এত দিন পরে এ বার নড়েচড়ে বসেছে জেলা স্বাস্থ্য দফতর। তড়িঘড়ি এই নিয়ে একটি বৈঠক ডাকা হয়েছে আগামী সোমবার। বর্ধমানের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তন্ময় মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “ক্লিনিক্যাল এস্ট্যাবলিশমেন্ট অ্যাক্টে জেলা নার্সিংহোমগুলিতে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা রাখতে হবে, এমন কোনও নির্দেশ নেই। কলকাতার ক্ষেত্রেই এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মাত্র দু’বছর আগে। ফলে আমরা এখানে নার্সিংহোমগুলিকে আইনত এই ব্যবস্থা নিতে বলতে পারি না।”
জেলা স্বাস্থ্য দফতরের লাইসেন্সপ্রাপ্ত নার্সিংহোমের সংখ্যা শুধু বর্ধমান শহরেই ৩৭। সব মিলিয়ে জেলায় রয়েছে মোট ২৩২টি নার্সিংহোম। যাদের বড় অংশেরই কোনও অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা নেই বলে জানিয়েছেন তন্ময়বাবু। তিনি নিজেই বলেন, “লাইসেন্স নবীকরণের সময় অনেক নার্সিংহোম কিছু অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থা রয়েছে বলে দেখায়। কিন্তু আগুন লাগলে তদন্তে গিয়ে সে সবের দেখা মেলে না। তাই আমরির ঘটনার পরে আমরা বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। জেলাশাসকের সঙ্গে কথা হয়েছে। আগামী সোমবার অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হবে। তার পরেই নার্সিংহোমগুলিতে অগ্নিনির্বাপক রাখা বাধ্যতামূলক করা হবে।”
এত দিন কেন এই ব্যবস্থা হয়নি? মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের যুক্তি, “জেলার নার্সিংহোমগুলিতে অনেক কিছুই নেই। স্বাস্থ্য বিধি মেনে তারা চলে না। উপযুক্ত শয্যার সংখ্যা, সর্বক্ষণের মেডিক্যাল অফিসার, নার্স, এ সবের অনেক কিছুই নেই। ঠিক মতো পরিদর্শন করলে এই সব নার্সিংহোমের বড় অংশই বিধি না মানার দায়ে বন্ধ করে দিতে হবে। কিন্তু তাতেও সমস্যা। বেশি সংখ্যক নার্সিংহোম বন্ধ হয়ে গেলে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপরে অতিরিক্ত চাপ পড়বে।”
বর্ধমান দমকল কেন্দ্রের সদর ফায়ার ওসি তপন মুখোপাধ্যায় বলেন, “নার্সিংহোমগুলি তো সব জুতগৃহ। বর্ধমান মেডিক্যাল-ও এই তালিকা থেকে বাদ যায় না। হাসপাতালে পরের পর কয়েক বার আগুন লাগার ঘটনায় গত ৩০ জুলাই আমি হাসপাতাল পরিদর্শনে যাই। অগস্টের প্রথম সপ্তাহে মোট সাত দফা অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নিতে লিখিত নির্দেশ দিয়েছিলাম হাসপাতালকে। বার বার খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এই ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনও ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি এখনও। যে কোনও দিন হাসপাতালে আমরির মতো অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। তখন আর কিন্তু কিছু করার থাকবে না।” |
কী ছিল সাত দফা নির্দেশে? তপনবাবু বলেন, “যেখানে অক্সিজেন সিলিন্ডার, স্পিরিট, এসি মেশিন, ওয়ার্মার, ব্লাড ব্যাঙ্ক, ওটি ইত্যাদি থাকবে সেখানে বাধ্যতামূলক ভাবে রাখতে হবে অগ্নি নির্বাপক। মান্ধাতার আমলের বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং বদলে ফেলতে হবে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর সব ঠিক মতো কাজ করছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। সমস্ত বিভাগের দু’জন করে কর্মীকে আগুন নেভানোর পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। লাগাতে হবে ফায়ার অ্যালার্ম ও স্মোক ডিটেক্টর। হাসপাতালকে এই সমস্ত ব্যবস্থা করার পরে দমকল দফতরের কাছ থেকে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট নিতে হবে।”
এই ব্যবস্থা গুলি কবে নেওয়া হবে, হাসপাতালের সুপার গদাধর মিত্রও তা বলতে পারেননি। তিনি বলেন, “আমি খোঁজ না নিয়ে কিছু বলতে পারব না। আমার আগের সুপারের আমলেই ওই নির্দেশগুলি দমকল দিয়েছে।”
তপনবাবু আরও বলেছেন, “প্রশাসন, পুরসভা, স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের সঙ্গে একটি বৈঠকে অনুরোধ করেছিলাম, নার্সিং হোমগুলিকে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার সময়েই ফায়ার লাইসেন্স নেওয়াটা বাধ্যতামূলক করতে হবে। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি।”
বর্ধমানের একটি নার্সিংহোমের মালিক হাদিয়া বেগম বলেছেন, “একেই তো নাসিংহোমগুলি রুগ্ন প্রতিষ্ঠান। তার উপরে ওই সব ব্যবস্থা করতে হলে রোগীদের আর্থিক অবস্থার উপরে প্রচুর চাপ পড়ে যাবে। আমরা অবশ্য আমাদের নার্সিংহোমে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা রেখেছি। কিন্তু সেটা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি।”
এ দিন বর্ধমানের খোসবাগানে সিএমওএইচ অফিসের সামনে আমরির শাখা কেন্দ্রে সকালেই তালাচাবি দিয়ে চলে যান সেখানকার লোকজন। ফলে কত জনকে বর্ধমান থেকে কলকাতার আমরি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল, তার তালিকা মেলেনি। জানা যায়নি, কেন আমরি হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের পরে তালা দিয়েছেন এখানকার কর্মীরা। |