|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
রুপোলি রেখা সব মেঘেই থাকে |
রতন জানা |
একটি তারার তিমির, অচ্যুত মণ্ডল। রেখা মণ্ডল, শিলিগুড়ি, ১০০.০০ |
জীবনানন্দ দাশের সাতটি তারার তিমির প্রকাশের প্রায় তেষট্টি বছর পরে, সম্প্রতি বেরিয়েছে অচ্যুত মণ্ডলের প্রথম কবিতার বই একটি তারার তিমির। গ্রন্থের সব চেয়ে দীর্ঘায়তন কবিতার নামেই এই নাম। কাব্যবিচারের গভীরে না-গিয়েও বলা চলে, দীর্ঘ কালখণ্ডের দুই প্রান্তের এই দু’টি বইয়ের নামসাযুজ্য আসলে জীবনানন্দেরই মহিমা কীর্তন। কিন্তু এটাকে অচ্যুতের প্রভাব-প্রবণতার প্রমাণ সাব্যস্ত করলে অতিসরলায়ন হয়ে যেতে পারে। বেঁচে থাকলে তিনি কবিতা সংগ্রহটিকে এই নামে আদৌ চিহ্নিত করতেন কি না, সংশয় দেখা দিতে পারে সেই বিষয়েও। জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের এক দিন’ কবিতার নায়ক চরিত্রটির মতো উদ্বন্ধনে অচ্যুতের আত্মলোপের পরে তাঁর স্বজনদের চেষ্টায় বেরিয়েছে এই বই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ধীমান ছাত্র ও শিক্ষক অচ্যুত কেন অকালে নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিলেন, জীবনানন্দের ভাষায়, সেটা এক ‘বিপন্ন বিস্ময়’।
তবে বিশ্ব-বিচ্যুত হওয়ার আগে বাংলা কাব্যের আবহমানতা থেকে চ্যুত হতে চাননি অচ্যুত। তিনি যে ঐতিহ্যেই লগ্ন থাকতে চেয়েছিলেন, সেই বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। বিলক্ষণ জানতেন, অভিনবত্ব সফল কবিতার অন্যতম শর্ত, কিন্তু কাব্যসংসারে অভিনব হয়ে ওঠা আকাশ থেকে পড়ার মতো কিছু হতে পারে না। ঐতিহ্যের আত্তীকরণ আর অনুশীলনই সেই অভিনবত্বে পৌঁছে দিতে পারে। তাই নিবিষ্ট পাঠ নিয়েছেন বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যের ধারাবাহিকতার কাছে। কিংবদন্তিপ্রতিম অগ্রজের ‘সাতটি তারার তিমির’-এর পাশে তাঁর ‘একটি তারার তিমির’ সেই জন্যই কোনও স্পর্ধিত মূঢ়তা বা অসার অনুকরণ-প্রবণতার সাক্ষ্য নয়। একটা ধারাবাহিকতার উত্তরাধিকার। অখ্যাত, অনতি-অগ্রজ কবির ‘হে ঘাতক, শ্মশানবান্ধবী’র ছায়াও একই অভিপ্রায়ের সূত্রে আতিথ্য পেয়েছে তাঁর ‘শ্মশানবান্ধবী’ চতুর্দশপদীতে। যেমন তাঁর কবিতার শিরোনামে আসন নিয়েছে ব্যোদলেয়ারের ‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’। আবার শম্ভু-তৃপ্তি মিত্রের শ্রুতি-অভিনয়ে স্মরণীয় ‘তাহার নামটি রঞ্জনা’
ডঙ্কা বাজিয়ে উঠে এসেছে অচ্যুতের কবিতায়:
“আমাদের এই গাঁয়ের নামটি সকলেই জানে পৃথিবী,
...
আমাদের সেই তাহার নামটি তারা হয়ে ওঠে আকাশে।”
শুধু শরীর নয়, কুসুমের মনও আছে বলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তর্কে মেতেছে তাঁর কবিতা।
‘প্রকৃতির গোদে বিষফোড়া দেখে বলে কাঞ্চনজঙ্ঘা’ অচ্যুত যখন এই চরণ লিখছেন, তার অনেক আগেই সুন্দরের প্রথাসিদ্ধতাকে তির্যক দৃষ্টিতে দেখার রবীন্দ্রোত্তর প্রবণতা পরিণত বয়সে পৌঁছে গিয়েছে। তবু যে তিনি লিখলেন ‘হে সূর্য, তামসপুত্র’,
তবু যে তিনি লিখলেন
‘কালো ভালবাসি, রাত্রির মতো, জীবনের মতো কালো
শাড়ি পরে এসে দাঁড়াবে না সূর্যের সোজাসুজি?’,
তার মূলে স্বতন্ত্র হয়ে ওঠার তরুণ তাগিদ ছাড়াও আছে ‘সম্পর্কের সাদা কালো সুতো রিপুর জটিল গ্রন্থি’। আলো আর অন্ধকার রহস্য বাড়িয়েছে তাঁর কবিতার। অন্ধকারের উৎস হতেই আলোর উৎসার দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর ‘অফুরন্ত রৌদ্রের অনন্ত তিমির’ ধরা পড়েছিল জীবনানন্দের ‘রিস্টওয়াচ’-এ। মানুষে মানুষে সম্পর্কের আলো-ছায়া আত্মস্থ করেই বাস্তবতার শর্ত মেনে নেয় শিল্প। অস্তিত্বের অর্থসন্ধানী আলো আর অস্তিত্বেরই অন্ধকার নিরর্থতা যাবতীয় ভাঙচুর নিয়ে গলাগলি করেছে অচ্যুতের কাব্যে। তাঁর কবিতায় ‘জামরুল গাছের সঙ্গে সান্ধ্য বৈঠকে বসল জোনাকির আলো’ এবং সেই বৈঠকেরও ‘প্রসঙ্গ আঁধার’।
বিজ্ঞান বলছে, আলোকময় নক্ষত্রের তিমির মানে তারার মৃত্যুতে তৈরি কৃষ্ণগহ্বর। পৃথিবীর সাপেক্ষে বহু আলোকবর্ষের দূরত্বের কারণেই মৃত নক্ষত্রের আলো এবং মৃত নক্ষত্রের কৃষ্ণগহ্বর একই সঙ্গে বর্তমান। তারার মৃত্যুর অনেক দিন পরেও তার আলো পেতে থাকে পৃথিবী। লোনা জলের দুস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও মানুষে মানুষে সম্পর্কের আরোহী-অবরোহী তান সেই নক্ষত্রপ্রকৃতিরই প্রতিফলন। যে-নক্ষত্রের আলোকলগ্নের প্রশ্রয়ে সম্পর্কের জন্ম হয়, তার মৃত্যু বা অপমৃত্যুর পরেও বয়ে যেতে হয় বন্ধনের অবহ ছায়াশরীর।
কোন অন্তর-তমসা মন্থন করে উঠে এসেছিল এলিয়টের কাব্যমাণিক্য, তার সফল অনুসন্ধান এখনও বাকি। আধুনিক বিশ্বকবিতার তিমিরাভিসার শুরু হয়েছিল ব্যোদলেয়ারের হাত ধরে, বলে থাকেন অনেকে। প্রকৃত পক্ষে ব্যোদলেয়ারের ‘ক্লেদজ কুসুম’-এর অনেক আগেই ফুটে উঠেছিল ভারতীয় ঐতিহ্যের পঙ্কজ পদ্ম, শালুক। ‘ফুটপাথ থেকে ব্যোদলেয়ারের বই কিনে দেব সখী’ এই আশ্বাসের পাশাপাশি অচ্যুত আত্মস্থ করেন সেই পদ্ম, সেই শালুক। ‘অনন্তের অভ্যেসের মতো তোমার, আমার ছেলেবেলা
রক্তাভ মণির চিহ্নে অজস্র শালুকে ফুটে ওঠে আমাদের চোখের পুকুরে।’
‘তবু বুঝি
পৃথিবী নামের দেশে কোথাও গভীর ভুল আছে।’
সেই ভুলের উৎস সন্ধানই কবির কৃত্য কি না, সেই ভুলের আরোগ্য কোন শিল্পবৈদ্যের কাজ, ব্যোদলেয়ার-ভ্যান গখ-র্যাঁবো-জীবনানন্দকে সঙ্গী করে তার উত্তর সন্ধানেই কি বেরিয়েছিলেন অচ্যুত? মাত্র চল্লিশেই তাঁর দুঃসহ অনুভব: ‘বন্দরে বন্ধনকাল কোনও দিন যেন ফুরোবে না’। রবীন্দ্রনাথের পাশেই ফের জীবনানন্দ: ‘থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার ব্যর্থ আয়োজন’। তা হলে?
মৃত নক্ষত্রের কৃষ্ণগহ্বর থেকে অচ্যুতের নতুন কবিতায় এই প্রশ্নের জবাব আসবে না।
বন্ধুদের সাক্ষ্য বলছে, অচ্যুতের রোজকার জীবন তেমন নিয়মাবদ্ধ ছিল না। অথচ তাঁর কাব্যপ্রয়াসের সাক্ষ্য এই যে, কবিতার কৃৎকৌশলের ক্ষেত্রে নিয়মনিষ্ঠায় ঘাটতি রাখেননি তিনি। একটি তারার তিমির গ্রন্থের সাঁইত্রিশটি কবিতার মধ্যে বাইশটিই চতুর্দশপদী, সনেটের পরীক্ষানিরীক্ষা। আর শতপদী নামকবিতাটি নিছক ছন্দোবদ্ধই নয়, তিমির-তপস্যাতেই তিমিরবিনাশের পদাবলিও। তাই যে-তারাটির তিমিরে তাঁর নিত্যস্নান, ‘সেই তাহার নামটি তারা হয়ে ওঠে আকাশে’।
তা হলে কি তারা হয়ে ওঠার তাগিদেই তারার তিমিরে সাঁতার কাটা! অথবা এই অভিযাত্রা অতটা সরলও নয় বুঝি। সেই জন্যই ‘আমার নাম তো অজ্ঞাত থাকে পাথরে ফসিলে চিরদিন...’, শুধু সে প্রেম ‘তারা হয়ে ওঠে আকাশে’। অচ্যুত সেই তারারই তিমির। সেই তিমিরাবর্ত তারার কবি অচ্যুত।
রুপোলি রেখা সব মেঘেই থাকে। সব তিমিরই আলোকসম্ভব। অকালপ্রয়াণে খণ্ডিত সম্ভাবনা মরুপথে ধারা হারানো নদীর মতো, যার সবটুকুই হারানোর নয়। অচ্যুত চলে গেলেও অসাড় উদাসীনতায় তাঁর কবিতাকে হারিয়ে যেতে দিলে বাংলা কাব্যের পাঠকেরই ক্ষতি।
অনেক টীকাকারের মতে, খণ্ডে খণ্ডে সব কবিই আসলে একটি অখণ্ড দীর্ঘ কবিতা লেখেন। কালের প্রবণতা মেনে খণ্ডকবিতাই লিখেছেন অচ্যুত। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন একটি ‘মহাগ্রন্থ’ লিখতে। হয়তো সেই কারণেই দীর্ঘদিন কাব্যানুশীলন করেও কোনও কবিতার বই প্রকাশ করে যেতে পারেননি, বা করে যেতে চাননি। অপমৃত্যুর পরে তাঁর স্বজনবন্ধুর পরিচর্যায় অত্যন্ত কঠোর নির্বাচনে বারো বছরের (১৯৮৬-১৯৯৭) কবিতা থেকে এই গ্রন্থ প্রস্তুত হয়েছে।
অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ের তমসাবৃত অথচ বাঙ্ময় প্রচ্ছদ ধারণ করে আছে গ্রন্থের আদ্যন্ত মেজাজ। কবির প্রকৃতিকে বুঝতে সাহায্য করে তন্ময় মৃধার স্মৃতিকথনটিও। তবু কবিতাসমূহ এবং গ্রন্থ শেষের গদ্য সর্বত্রই পীড়াদায়ক বানান ভুলের জন্য খেদ থেকেই যায়। ‘ধন্বন্তরী’ বা ‘পাণিণি’ কেউই সেই ভুলের ফাঁদ থেকে রেহাই পাননি। ‘পাণিনির অনুপ্রেরণা’ কবিতাটি সূচিপত্র থেকেই বেমালুম বেপাত্তা! উদ্যোক্তাদের আরও একটু সতর্কতা, আরও একটু মনোযোগ পেতে পারত গ্রন্থটি। |
|
|
|
|
|