|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
সহজাত, স্বাভাবিক কিন্তু অবাঞ্ছিত |
অভিজিৎ চৌধুরী |
ক্যানসার/পুরনো ভয়, নতুন ভাবনা, স্থবির দাশগুপ্ত। মিত্র ও ঘোষ, ১৬০.০০ |
সুখ কী, তা আসে কোন পথে, কেমনই বা তার অনুভূতি এই প্রশ্নে দৃষ্টিভঙ্গি এবং দর্শন চিরকালই বহুধাবিভক্ত। একমাত্রিক ধ্যানধারণা যা বহু ক্ষেত্রেই আমাদের চিন্তাকে প্রভাবিত করে, তাতে সুখের রূপবর্ণনার সঙ্গে অসুখের অনবস্থান এই দুটিকে এক করা হয়। সুখে থাকা, ভাল থাকা আর অসুখ না থাকা এই বিষয়গুলি যেন এক সরলরেখায় দাঁড়িয়ে। মৃত্যু পৃথিবীতে চরম, অনিবার্য শোকাবহ ঘটনা তা আসে ‘অসুখের’ হাত ধরেই। অতএব অসুখকে সামলাতে পারলেই ভাল থাকবে পৃথিবী। কাজেই এই ‘অসুখ’ নিধনই আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং সমাজের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত এ রকম একটা ধ্যানধারণা আধুনিকতার পথে হাঁটা চিকিৎসা বিজ্ঞানের অস্তিত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে উঠে আসছে। বিজ্ঞান প্রতি দিন সন্ধান দিচ্ছে নতুন নতুন অসুখের, তাদের নানান রকম চরিত্রের। এরই পাশাপাশি উচ্চারিত হচ্ছে নিরূপণ আর নিরাময়ের নানান ‘মডার্ন’ পথ অনেকটা রিলে রেসের ব্যাটন হাত থেকে হাতে যাওয়ার ছন্দে তা সাজানো। কখনও সাংবাদিকতায়, কখনও বা আলেখ্য হয়ে এই তথ্যগুলি চিকিৎসা বিজ্ঞানের গল্প-শোনায়-ব্যাকুল মানুষের কাছে প্রতি দিন পৌঁছচ্ছে কখনও বা ‘কোলাহল’, কখনও তা ‘কানাকানি’ হয়ে। পাশাপাশি বাজার অর্থনীতির মুক্ত বিহঙ্গের ডানায় ভর করে চিকিৎসা ‘শিল্প’ তার সামাজিক সুরক্ষার ম্যারাপ বাঁধা বলয় ছেড়ে আমাদের দরজায় হাজির নতুন রূপে, পেখম মেলে, বিনিয়োগ আর লাভ-লোকসানের শ্রেষ্ঠীয় হিসাব নিয়ে। তার দু’হাতে ভরা অসুখের পসরা। কণ্ঠে তার ‘অসুখ’বিহীন জীবনের প্রতিশ্রুতি।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিগত ভিত্তি হিসাবে যে চিন্তা ক্রমশ বিকাশলাভ করছে তা হল জীবন এক জটিল ঘূর্ণাবর্ত, জীবনটাকে ‘অসুখবিহীন’ রাখার আশু প্রয়োজনে তা নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রতি দিন পরখ করতে হবে। সমাজ-মানসেও ক্রমাগত এই ভাবনা দৃঢ় হচ্ছে, এই প্রশ্ন উঠে আসছে যে, অসুখবিসুখের প্রাচীর-ঘেরা এই জীবন নামের যক্ষপুরীতে কখনও কি ‘সুখের’ আলো আসবে হয়তো বা কোনও এক ফাটল দিয়ে। ‘অসুখ’ই হচ্ছে জীবনে নিত্য, স্থিতি। ‘সুখ’ হচ্ছে মরুতৃষা।
সর্বব্যাপী চিন্তার আবহে স্থবির দাশগুপ্তের লেখা ক্যানসার/ পুরনো ভয়, নতুন ভাবনা এক ঝলক নতুন আলো। যুক্তিশীল, অনুসন্ধিৎসু মন আর চেতনা নিয়ে সুখ-অসুখের মাঝে পরিব্যাপ্ত জীবনের বর্ণমালা দিয়ে তা আমাদের কাছে হাজির। বিজ্ঞান-সাংবাদিকতার অতিসরলীকৃত ব্যাখ্যা, বিজ্ঞান-আলেখ্যর কুহকের মোড়ক, ‘বিশুদ্ধ’ বিজ্ঞানচর্চার কাঠিন্য আর যান্ত্রিকতা এগুলিকে সযত্নে এড়িয়ে সুপাঠ্য, মননশীল বিজ্ঞান অভীক্ষা এই বইটির লক্ষ্য। এমন নিবিড়, বস্তুনির্ভর বিজ্ঞান আলোচনা বাংলা ভাষায় কমই হয়েছে। ‘ক্যান্সার’ এখানে লক্ষ্য, উপলক্ষ এবং রূপকল্প। জীবনের পাকদণ্ডিতে আর দশটা ঘটনার মতো ক্যান্সারও যে একটা ঘটনা মাত্র এই চিন্তাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে ধাপে ধাপে। আর তা হয়েছে প্রচলিত বিজ্ঞানের মানদণ্ডের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, কিন্তু নির্মোহ, বৈজ্ঞানিক ‘কুসংস্কার’ বিবর্জিত দৃষ্টিতে। দুর্জন এটাকে ‘স্বদেশি’ ক্যান্সার আলেখ্য বলতেই পারেন তাতে লেখকের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন হবে না। বিজ্ঞান সচেতনতার প্রশ্নটি বিভিন্ন অঙ্গনে প্রায়ই আলোচিত হয়। আর সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োগ-কৌশলের ফলে চিকিৎসাবিজ্ঞান হয় দশচক্রে ভগবান ভূত। স্বাস্থ্য সচেতনতার নামে তৈরি হয় রোগ সচেতনতা তা দাঁড়ায় গিয়ে ‘রোগভীরুতায়’। ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গিগত নৈরাজ্যের প্রভাব সব থেকে বেশি।
ক্যান্সার মানেই বৃশ্চিক দংশন, অবধারিত মৃত্যু আর তা হয় নিজেরই নানান পাপকর্মের ফলে এই জাতীয় নানান ধ্যান-ধারণা আমাদের পরিমণ্ডলে যথেষ্টই বেগবান। ‘আহা রে! ক্যান্সার হয়েছে’ এই সামাজিক করুণা আর সহানুভূতির বর্ষণ ক্যান্সার যাদের হয়েছে, তাঁদের প্রতি দিন সিক্ত করে আর মানসিক ভাবে করে রিক্ত। তাঁরা আরও কুঁচকে যান, ক্রমাগত হারিয়ে যেতে থাকেন নিজেদের মধ্যে। এরই পাশাপাশি অলিতে-গলিতে বিজ্ঞাপন ‘আগে বুঝলে ক্যান্সার সারে, ছড়িয়ে গেলে ভয়ঙ্কর এক্ষুনি আসুন’ গোছের প্রচার তাঁদের পাপদগ্ধ করে প্রতি মুহূর্তে। উন্নত চিকিৎসার যে মার্গ, তাতে পথ হাঁটতে গিয়েও নানান হোঁচট, আর্থিক এবং শারীরিক। এর অনেকগুলিই চিকিৎসা থেকে উদ্ভূত। অসুখের নাগপাশে আবদ্ধ হওয়ার অনুভূতি, রোগমুক্তির পথের কাঁটার ব্যথা, সামাজিক করুণা বর্ষণ এ এক বেদনাবিধুর উপাখ্যান। লেখক এর বিপরীতেই তার আলেখ্য সাজিয়েছেন যুক্তি দিয়ে, বিজ্ঞানের শক্তিতে ভরসা রেখে।
বিজ্ঞানকে মানবগ্রাহী হতে গেলে তা শুধু মেধার দীপ্তির ওপর ভর করে হয় না। লাগে পরিব্যাপ্ত, খণ্ডতা-বিবর্জিত চিন্তা, লাগে প্রজ্ঞার পরশ। পদার্থ বিজ্ঞানের অণু-পরমাণুর বিশ্লেষণে যেমন তত্ত্বের ভিত্তি, গুরুত্বপূর্ণ কোষের জৈবিক ব্যবহার সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিগত স্বচ্ছতা ঠিক সে রকম ভাবেই ক্যান্সারের ভিত্তি বোঝার জন্য আবশ্যক। স্পষ্ট উচ্চারণে এবং নিজের চিকিৎসকজীবন থেকে আহরিত ধ্যান-ধারণার ওপর যুক্তির বর্ণমালা সাজিয়ে লেখক বুঝিয়েছেন যে ‘ক্যান্সার’ জীবনেরই এক অন্য, অশিষ্ট রূপ সহজাত, স্বাভাবিক কিন্তু অবাঞ্ছিত। কোষের অনুপম নাট্যকলার এটি একটি দৃশ্য। তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিয়োগান্তক নয় যেমনটি দেখানো হয়। ‘তিমির বিনাশের’ পথে হাঁটতে গিয়ে ক্যান্সারবিজ্ঞান যে বহু ক্ষেত্রেই পথভ্রষ্ট, ‘তিমিরবিলাসী’ এবং ভ্রমসঞ্চারী হয়েছে তা ছত্রে ছত্রে দেখিয়েছেন লেখক।
জীবনভর হৃদয় ও মনন ব্যবহার করে রোগী দেখা এক চিকিৎসকের কলমে ‘ক্যান্সারবিজ্ঞান’ এখানে সাহিত্যরসে ভরা। যাদের কখনও ক্যান্সার হয়েছে, এই বই তাঁদের প্রেরণা দেবে। অন্ধকারের পথহাঁটা চিকিৎসা-বিজ্ঞানী এবং ক্যান্সার ব্যবসায়ীদের ভ্রূকুটি করবে। যাঁরা নতুন করে ভাবতে চান, তাঁদের জন্য আছে ‘জীবনের অনন্ত সুধা-সাগরে’ ডুব দেওয়ার আমন্ত্রণ। |
|
|
|
|
|